করোনাজয়ী ২৬ চিকিৎসকসহ ৪৯ কর্মী কাজে যোগ দিচ্ছেন
মা ও ছেলে দুজনে করোনামুক্ত হয়েছেন। মায়ের নাম রুম্মন বিনতে সুবহান। পেশায় তিনি চিকিৎসক। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে কর্মরত। করোনাজয়ী তাঁর ছেলের বয়স মাত্র চার বছর।
মিটফোর্ড হাসপাতালের করোনার উপসর্গ নিয়ে আসা লোকজনের বহির্বিভাগে চিকিৎসা সেবার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন চিকিৎসক রুম্মন বিনতে সুবহান। দুদিন করোনার উপসর্গ নিয়ে আসা ব্যক্তির নমুনাও সংগ্রহ করেন। যখন জানতে পারেন, বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা কয়েকজনের করোনা পজিটিভ এসেছে, তখন নিজেও করোনার নমুনা পরীক্ষা করানোর সিদ্ধান্ত নেন। পরীক্ষায় ধরা পড়ে করোনা পজিটিভ। তখন নিজ বাসায় আইসোলেশনে থেকে চিকিৎসা নেওয়া শুরু করেন। দুদিন পর চার বছর বয়সী তাঁর একমাত্র ছেলেরও করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে।
আমাদের আক্রান্ত ৪২ জন চিকিৎসকের মধ্যে ইতিমধ্যে ২৬জন চিকিৎসক করোনা মুক্ত হয়েছেন। দু-একদিনের মধ্যে তাঁরা আবার কাজে যোগ দেবেন: অসীম চক্রবর্তী, সমন্বয়ক, করোনা ইউনিট, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল
সামান্য ঠান্ডা, কাশি জ¦র থাকলেও দুজনের কারও শারিরীক অবস্থা খারাপ না হওয়ায় বাসাতেই তাঁরা ১৪ দিন ধরে আইসোলেশনে থাকেন। সম্প্রতি দুজনের করোনা নেগেটিভ এসেছে।
মিটফোর্ড হাসপাতালের চিকিৎসক রুম্মন বিনতে সোবহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এবং আমার চার বছর বয়সী ছেলে এখন করোনামুক্ত। কখনও বাসায় এভাবে একা এক ঘরে বন্দি ছিলাম না। করোনার কারণে থাকতে হয়েছে। বাসায় গরম পানি খেয়েছি, নাকের ভেতর গরম পানির ভাপ দিয়েছি। আমাদের হাসপাতাল থেকে দেওয়া ওষুধ নিয়মিত খেয়েছি। শরীর ভালো থাকায় আর আমাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া লাগেনি। ইতিমধ্যে হাসপাতালের ডিউটি রোস্টারে নাম এসেছে। আবার চিকিৎসা সেবা দেওয়া শুরু করব।’
গত ২৫ দিনে পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের ৪২ জন চিকিৎসকসহ ১০২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য বলছে, গতকাল পর্যন্ত ২৬ জন চিকিৎসক, ১২ জন নার্স এবং ১১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনা মুক্ত হয়েছেন।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের করোনা ইউনিটের সমন্বয়ক চিকিৎসক অসীম চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার উপসর্গ নিয়ে আসা কয়েকজন রোগী গত এপ্রিল মাসের প্রথমদিকে আমাদের হাসপাতালে ভর্তি হন। কিন্তু তাঁরা কেউই করোনার উপসর্গ থাকার কথা আমাদের জানাননি। পরবর্তীতে ওইসব রোগীর করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে। এরপর থেকে আমাদের চিকিৎসক, নার্স, হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারী একের পর এক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে শুরু করেন। তবে আশার খবর, আমাদের ৪২ জন চিকিৎসকের মধ্যে ইতিমধ্যে ২৬জন চিকিৎসকসহ সর্বমোট ৪৯ জন করোনা মুক্ত হয়েছেন। দু-একদিনের মধ্যে তাঁরা আবার কাজে যোগ দেবেন।’
চিকিৎসক কে এম নাজমুল আলম স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি এক ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে পুরান ঢাকায় বসবাস করেন। করোনার উপসর্গ নিয়ে রোগী আসতে শুরু করার পর স্ত্রী আর ছেলের কথা চিন্তা করে তাদের গ্রামের বাড়িতে রেখে আসেন। পরবর্তীতে যথারীতি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছিলেন। তবে গত ১৮ এপ্রিল জ¦র নিয়ে মেডিসিন বিভাগে একজন রোগী ভর্তি হন। দুদিন পর জানা যায়, ওই রোগী করোনা পজিটিভ। পরে রোগীকে করোনার চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত সরকারি হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরদিন মেডিসিন বিভাগের একজন ওয়ার্ডবয়ের করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে। তখন চিকিৎসক কে এম নাজমুল আলমেরও জ¦র আসে, গায়ে ব্যাথা হয়। গত ২৩ এপ্রিল পরীক্ষায় তার করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে। তখন থেকে নিজ বাসায় আইসোলেশনে রয়েছেন। দু-একদিন আগে তাঁর করোনা নেগেটিভ এসেছে।
মিটফোর্ড হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার কে এম নাজমুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মার্চের ১০ তারিখের পর থেকে আমাদের হাসপাতালে করোনার উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীরা আসছিলেন। তাই আমি গত ১৭ মার্চ আমার স্ত্রী আর সন্তানকে নাটোরে আমার গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিই। বাসায় আমি একা থেকে হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা চালিয়ে যেতে থাকি। আমার বিভাগে করোনার উপসর্গ নিয়ে আসা একজন রোগী ভর্তি হওয়ার পর আমি গত ২৩ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হই। সেই থেকে আমি বাসায় একা। বাসায় নিজের বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে সবসময় যোগাযোগ রেখেছি। নিজের মনোবল ধরে রেখেছিলাম। বাসায় নিয়ম করে গরম পানি আর ওষুধ সেবন করেছি। এভাবে টানা ১৭-১৮ দিন বাসায় থেকেছি। আমার করোনা নেগেটিভ এসেছে। আমি শুধু বলব, কেউ করোনাকে ভয় পাবেন না। সতর্ক থাকার পরও যদি আক্রান্ত হয়ে যান, তাহলে নিজের মনোবল ধরে রাখুন। নিশ্চিত করোনাকে পরাজিত করতে পারবেন।’
করোনামুক্ত ১৩ ইন্টার্ণ চিকিৎসক:
তাহমিদ জামান স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের ইন্টার্ণ চিকিৎসক। থাকেন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হোস্টেলে। গত ২০ এপ্রিল তাহমিদের রুমমেটের করোনা ভাইরাস ধরা পড়ে। পরে তিনিও হাসপাতালে গিয়ে করোনা শনাক্তের জন্য নমুনা দিয়ে আসেন। জানতে পারেন, তিনি নিজেও করোনা পজিটিভ। এরপর একে একে হোস্টেলের আরও তিনজন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। তখন হোস্টেলের পাশাপাশি পাঁচটি কক্ষে তাঁরা আইসোলেশনে থাকতে শুরু করেন। সম্প্রতি সবার করোনা নেগেটিভ এসেছে।
করোনা জয়ী ইন্টার্ন চিকিৎসক তাহমিদ জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের এই ক্রান্তিকালে আমরা চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়েই কিন্তু আমরা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছি। আমিসহ আমাদের হাসপাতালের মোট ১৩ জন ইন্টার্ণ চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হই। আমরা সবাই আইসোলেশনে থেকে চিকিৎসা নিয়েছি। নিজেদের মনোবল ধরে রেখে সঠিকভাবে খাওয়া-দাওয়া করেছি, হাসপাতালের দেওয়া ওষুধপত্র সেবন করেছি। সবথেকে খুশির খবর, আমরা ১৩ জন ইন্টার্ণ চিকিৎসক করোনাকে জয় করেছি।’
তাহমিদ জামান আরও বলেন, ‘আমার বোন অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। বোনের সঙ্গে দেখা করতে মা এখন অস্ট্রেলিয়া আছেন। মোবাইল ফোনে আমার করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর শুনে মা তখনই দেখে আসার জন্য আপ্রান চেষ্টা করেন। আমি মাকে সান্ত¡না দেওয়ার চেষ্টা করেছি। সত্যি কথা বলতে কী, একই হোস্টেলে আমরা পাঁচজন পাশাপাশি ছিলাম। আমার বন্ধুরা হোস্টেলের খাবার রেখে যেত। কাছাকাছি যেতে পারতাম না। শুধুমাত্র মোবাইল ফোনে কথা হতো। মাঝেমধ্যে মন খারাপ হতো। তবে মন ভালো রাখার জন্য গান শুনতাম, বই পড়তাম। আর মোবাইল ফোনে বাবা-মাসহ প্রিয়জনদের সঙ্গে কথা বলতাম। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সবথেকে বড় কষ্ট একটি কক্ষে একা থাকা। তবে মনোবল ধরে রাখতেই হবে।’
মিটফোর্ড হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক ফারিয়া হাবীব করোনাকে জয় করেছেন। তিনিও গত এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন। নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা একজন রোগী নিজের করোনা উপসর্গ থাকার কথা লুকিয়ে ভর্তি হন। ওই রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার সঙ্গে জড়িত কয়েকজন চিকিৎসক করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে তিনিসহ তাঁর তিন বান্ধবী করোনায় আক্রান্ত হন।
ইন্টার্ণ চিকিৎসক ফারিয়া হাবীব প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনা ধরা পড়ার পর আমি আমার বোনের বাসায় আইসোলেশনে থাকা শুরু করি। টানা ১৮ দিন আমি একরুমেই ছিলাম। আমার রুমের বাইরে খাবার রেখে যাওয়া হতো। বেশিরভাগ সময় কেটেছে গান শুনে, বই পড়ে। আর আমার যেসব বান্ধবী করোনায় আক্রান্ত হয়েছে, তাদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলতাম। কখনও মনোবল হারাইনি। প্রথম দিকে শরীর একটু খারাপ লাগলেও পরে আর খারাপ বোধ করিনি। একটি কথাই আমি বলব, যত কষ্টই হোক, মনোবল কিন্তু হারাবেন না। মনের সাহস কিন্তু অনেক বড় ব্যাপার। অনেক বড় ওষুধ।’