লায়লাতুল কদর, বা শবে কদর, একটা নির্ধারিত রাত নয়
—-শাহবাজ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান স্যাইয়েদ হোসাইন শাহবাজী।
লাইলাতুল কদর রমজান এর ভিতরেও হতে পারে আবার রমজান এর বাহিরে ও হতে পারে। কিছু কিছু আউলিয়ায়ে কিরামের মতে, লাইলাতুল কদর প্রতি বছরের যে কোন রাতে হতে পারে। লায়লাতুল কদর কবে, তা নিয়ে ৪৬ টি আলাদা মত আছে. তাই আমাদের প্রতি রাতে শবে কদর খুঁজতে হবে। যেদিন আপনি আল্লাহ এর নৈকট্য ও আধ্যাত্মিকতা অনুভব করেন, সেটিই আপনার জন্য শবে কদর হতে পারে।
আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহা নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, “লাইলাতুল কদরে আমি কি দোয়া করতে পারি?” তিনি বললেন,
ﺍﻟّﻠﻬُﻢ ﺇِﻧَّﻚَ ﻋَﻔُﻮٌّ ﺗٌﺤِﺐُّ ﺍﻟﻌَﻔْﻮَ ﻓَﺎﻋْﻒُ ﻋَﻨِّﻲْ
.
( আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আ’ফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নি )
“হে আলাহ ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে ভালোবাসেন, অতএব আমাকে ক্ষমা করুন।”
[তিরমিজি ৩৫১৩,ইবনে মাজাহ ৩৮৫০]
ইমাম নাভাভি রহমাতুল্লাহি আলাইহি এবং অন্য স্কলারগণ ব্যাখ্যা করেছেন যে ‘কদরের রাত হাজার মাসের চেয়ে উত্তম,’ এর অর্থ “এ রাতটি শবে কদর বিহীন এক হাজার মাসের চেয়ে উত্তম।”
এই রাতের মাহাত্মের প্রতি লক্ষ্য রেখে, আমাদের উচিৎ এই রাতটি নামায, দোয়া , যিক্রসহ অন্যান্য ইবাদাতের মাধ্যমে অতিবাহিত করা, এ রাতে শবে কদর সন্ধান করা।যেহেতু ফরজ ইবাদাত আল্লাহর নিকট নফল ইবাদাতের চেয়ে বেশি প্রিয়, তাই পুরুষদের উচিৎ মসজিদে ইশা ও ফজর উভয়ের নামাজ আদায় করা।
লাইলাতুল কদর কবে তালাশ করতে হবে ?
এ সম্পর্কে প্রচুর মতভেদ রয়েছে, কারণ এ বিষয়গুলোর ব্যাপারে কোন জ্ঞান আল্লাহ তাআলা উম্মতের মাঝে দিয়ে রাখেননি, যাতে করে লোকেরা নিজে থেকে শবে কদর তালাশ করার চেষ্টা করে।
সাধারণভাবে, এ ব্যাপারে অনেকেই একমত যে রমজান মাসের শেষ দশটি রাতের মধ্যে শবে কদর হওয়ার বেশি সম্ভাবনা রয়েছে, সাথে বিজোড় রাতগুলোতে আরো বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বিজোড় রাতের মধ্যে ২৭ তারিখের রাতটি তথা ২৬ এর দ্বিবাগত রাত। ইমাম শাফিঈর মতে লাইলাতুল কদর হওয়ার সর্বাধিক সম্ভাবনাময় তারিখ ২১ রমজান, নতুবা ২৩ রমজান, নতুবা ২৭ রমজান । ইমাম নাভাভী, ইমাম মুযানী ও ইমাম ইবনে খুযাইমার অবস্থান অনুযায়ী লাইলাতুল কদর রমজান মাসের শেষ দশ রাতের মধ্যে আবর্তন করে। [নাভাভী, আল-মাজমু` শারহ আল-মুহাদ্দাব, ৬/৪৮৮]।
তবে, এটি রমজানের মধ্যে শেষ দশ রাতের বাইরেও হতে পারে। এমনকি পূর্ববর্তী ও পরবর্তী উলামায়ে কিরামের মতে এটি রমজানের বাইরেও হতে পারে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনেক সাহাবীর নিকট হতে এমনটি বর্ণিত হয়েছে, যাদের মধ্যে ইবনে মাসউদ রাঃ অন্যতম। একটি মতানুসারে ইমাম আবু হানিফারও মত এটি , এবং ইবনুল আরাবী (যার অবস্থানটি ইবনে আবিদীন সমর্থনের দ্বারা স্পষ্ট হয়েছে), আবু’ল হাসান আল-শাযুলি,শা’রানী সহ অনেক মহান জ্ঞানী এ মতটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উত্তরসূরিদের পদাঙ্ক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনুসরণ করার দ্বারা সফলকাম হওয়ার তাউফিক দান করুন এবং তিনি যেন আমাদেরকে তাঁর প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত করে দেন।
***প্রতিদিন তাহাজ্জুদের নামায পড়ার প্রচেষ্টা কেন করা উচিত তার একাধিক কারণ।
ব্যাখ্যা
বর্ণিত হয়েছে যে, “একবার রমজানের শেষ দশ দিন শুরু হয়ে গেলে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর আহলে বাইত এবং সাহাবীগণ ইবাদতের মাধ্যমে ও পরিবার সদস্যদের ঘুম থেকে জাগ্রতকরতঃ রাত্রি অতিবাহিত করতেন। , তিনি ইবাদাতের উদ্দেশ্যে কোমড় বেধে নিতেন।
ইমাম আবু হানিফা ও তাঁর দুই প্রধান সাথী আবু ইউসুফ এবং মুহাম্মদ ইবন্ আল-হাসান রহমাতুল্লাহি আলাইহিম এর প্রতিষ্ঠিত মতানুযায়ী লাইলাতু কদর রমজানের জন্য নির্দিষ্ট। আবু হানিফা বলেছিলেন যে এটি কোন নির্দিষ্ট দিন নয়, বরং মাসের মাঝে ঘোরাফেরা করে। (ইবনে আবিদীন, রদ্দ-মুহতার, আল-বাহর ও আল-কাফী থেকে)। ইবনে আবিদীন উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম আবু হানিফার ব্যাখ্যামতে যে হাদীসগুলোয় ২৭ তারিখ এর কথা এসেছে সেগুলো নির্দিষ্ট একটি বছরের জন্য ।
ইবনে আবিদীন ইবনে নুযাইমের বাহ্রু রায়েক্ব হতে নকল করেছেন যে, এটি ইমাম আবু হানিফার অবস্থান যা, কাদীখানে উল্লিখিত,” লাইলাতুল কদর সারা বছর ঘুরে বেড়ায়; এটি রমজানে হতে পারে এবং এটি অন্য মাসেও হতে পারে।”
ইবনে আবিদীন শামী বলেন,
“আরিফ বিল্লাহ সাইয়িদী মুহ্য়ুদ্দীন ইবনুল আরবী তাঁর ফুতুহাত আল-মক্কিয়াতে এ মতটিকেই সমর্থন করেছেন।
লাইলাতুল কদর সম্পর্কে লোকদের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল। কেউ কেউ বলেছিলেন যে এটি সারা বছর এর যে কোন দিন হতে পারে । এটি আমারও অবস্থান, কারণ আমি এটি শাবান মাসে এবং রবিউল আউয়াল বা রবিউস সানী এবং রমজান মাসে পেয়েছি।যদিও, আমি এটি সবচেয়ে বেশি দেখেছি রমজান মাসে এবং বিশেষত শেষ রাত্রিগুলোতে। আমি রমজানের দ্বিতীয় দশকের বিজোড় ও জোড় উভয় রাত্রিতে লাইলাতু কদর পেয়েছি ।দেখেছি। অতএব, আমি নিশ্চিত যে এটি পুরো বছর জুড়ে, বিজোড় এমনকি রাত্রেও ঘোরাফেরা করে থাকে।”
এবং এ সম্পর্কে ৪৬ টি ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। ” [ইবনে আবিদীন, রদ্দ আল মুহতার]
এটি ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং অন্যান্য মহান সাহাবীদের অবস্থান বলে জানা গেছে। [যেমন বুটুতি তাঁর কাশফ আল-কিনাতে এবং অন্যদের মধ্যে উল্লেখ করেছেন; লাইলাতুল কদর সম্পর্কে সাহাবা ও অনুসারীদের বহু বর্ণনার জন্য, দেখুন ইবনে আবী শায়বার মুসান্নাফ]
ইমাম আল-নাফরবী আল-মালিকি তাঁর “আল-ফাওয়াকীহ আল-দাওয়ানী ফী শারহ রিসালাত ইবনে আবি জায়েদ আল-কায়রওয়ানী” নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, “ইমাম মালিক, ইমাম শাফিয়ী ও ইমাম আহমদ এবং অধিকাংশ আলেমের মতে লাইলাতুল কদর কোন নির্দিষ্ট রাত নয়। বরং এটি আবর্তমান রাত্রি”।