শিশুদের মুক্তমনা খেলাধুলা ও মানসিক স্বাস্থ্য

Spread the love

সৈয়দ হোসেন শাহবাজী, বিশেষ প্রতিবেদকঃ বিশ্বব্যাপী বিষন্নতা এবং দুশ্চিন্তাজনিত রোগের মাত্রা দিনদিন বেড়েই চলেছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে তরুণ সমাজের মাঝে। আমেরিকার মতো উন্নত দেশে গত ৫০ বছরে তরুণ সমাজে বিষন্নতা ও দুশ্চিন্তার হার বেড়েছে প্রায় ৫-৮ গুন। কি এর কারণ? আমরা ইদানিং মানসিক রোগ নিয়ে সচেতন হওয়ার কারণেই কি সমস্যা ধরা পড়ছে বেশি? স্যান ডিয়েগো স্টেট ইউনিভার্সিটির Jean Twenge একই পরিমাপক স্কেল ব্যবহার করেন ১৯৩৮-৫০ সালের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ও বর্তমানের ছাত্রদের উপর। দেখা যায়, ৫০-৬০ বছরে শিশু-কিশোরদের বিষন্নতা ও দুশ্চিন্তা জনিত রোগের মাত্রা নাটকীয় ভাবে বেড়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের এই অবনতির জন্য মূলত কি দায়ী? অনেকেই ভেবেছেন, বর্তমানের প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব, সমাজের যুদ্ধ-হানাহানিই দায়ী। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্বযুদ্ধ ১/২ বা ‘৭০ এর ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ের পরেও শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য বর্তমান থেকে ভালো সূচক বহন করত! তাহলে এর কারন কি? মানুষ যখন মনে করে, তার সম্পূর্ণ ভবিষ্যতটুকুই নিয়তির হাতে, তখন সে অতিরিক্ত হতাশ হয়ে পড়ে। যদিও বর্তমানে আগের তুলনায় মানুষের আর্থিক সঙ্গতি বেড়েছে, রোগবালাই অনেকাংশেই নির্মূলের পর্যায়ে, সামাজিক নানা সমস্যা কমেছে, তবুও আগের তুলনায় মানুষ এখন অনেক বেশি বিশ্বাস করে যে তাদের হাতে তাদের কোন কিছুই নেই! সব ভাগ্যের হাতে! এই ধারণা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভয়ঙ্কর! এসব ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা পালন করে আমাদের জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রবিন্দুটি কোথায় সেটি। যদি নিজেকে নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রবিন্দুটি আভ্যন্তরীণ হয়ে থাকে, তবে তাদের ক্ষেত্রে সুখী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যেমন ধরুন, আমার একটি পরীক্ষায় ফেল করলাম। ব্যাপারটা যদি আমি এভাবে চিন্তা করি যে, আমি পড়িনি, তাই আমার দোষে আমি ফেল করেছি – এটা আভ্যন্তরীণ কেন্দ্রবিন্দু বা Internal locus of control। কিন্তু যদি আমি এভাবে চিন্তা করি, আমার ভাগ্যে ছিল তাই ফেল করেছি, তাহলে এটি হলো বাহ্যিক কেন্দ্রবিন্দু বা External locus of control। Twenge ও তার সহকর্মীরা গবেষণা দেখেন, ১৯৬০-২০০২ সালের মধ্যে ৯-১৪ বছর বয়সী শিশুরা নিজেকে নিয়ন্ত্রণের জন্য Internal locus of control বা আভ্যন্তরীণ কেন্দ্রবিন্দু থেকে সরে এসেছে। ‘৫০ এর দশকে যেকোন একজন সাধারন মানুষ থেকে বর্তমানের সাধারণ একজন নাগরিক ৮০% ক্ষেত্রে মনে করেন যে, আশেপাশের কারণে তার আচরণ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এই কারণেই মানুষ নিজের দায়িত্বভার নিজে নিতে চায় না, আর নিজের বিভিন্ন আচরণের জন্য অন্যকে দোষারোপ করে! একজন মানুষ যখন মনে করে “আমার হাতে তো কিছুই নেই! কাজ করে আর কি হবে!” – তখন হতাশ হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেশি! Twenge তার নিজস্ব মতামত প্রকাশ করে বলেন, এই জেনারেশনের অতিরিক্ত বিষন্ন এবং হতাশায় ভোগার মূল কারণ হলো, আগে বা তারও আগের জেনারেশনের মানুষজন অধিকাংশ সিদ্ধান্ত নিজের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে নিত, নিজের উন্নয়নের জন্য। অথচ আজকাল অধিকাংশ মানুষই সিদ্ধান্ত নেয় অন্যজন কি ভাববে, অথবা গাড়ি-বাড়ি, টাকা-পয়সা এগুলোর উপর নির্ভর করে। এই External locus of control এর জন্য মানুষ পারিবারিক, ব্যক্তিগত, সামাজিক ও পেশা জীবনে বিষণ্নতার শিকার হচ্ছে । Twenge বলেন, আমাদের চিন্তা ভাবনা বদলের একটি মূল কারণ হলো টিভি, পত্রিকা, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আমাদেরকে বৈষয়িক জ্ঞান দেওয়া। সাফল্য বলতে আমরা বুঝি টাকা-পয়সা, খ্যাতি আর সুন্দর অবয়বের অধিকারী হওয়া। এর ফলে আমাদের আত্মসচেতনতা এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞান দিন দিন কমছে। আমাদের External locus of control এর প্রতি সরে যাওয়ার একটি বড় কারণ হলো, আমরা শিশুদের খেলা থেকে সরিয়ে পড়াশোনার প্রতি ধাক্কা দিয়ে দিচ্ছি! বাচ্চাদের মুক্ত খেলার মাধ্যমে খেলা বাদেও অনেকগুলো জিনিস হয়। ফ্রি প্লে বা মুক্তভাবে খেলার মাধ্যমে তারা নিজের সুপ্ত আগ্রহ সম্বন্ধে জানতে পারে, বাকিদের সাথে মিশতে পারে, এবং একা একা বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে শিখে। এর মাধ্যমে শিশুরা বুঝতে পারে যে তাদের ইচ্ছার উপরে অনেক কিছু নির্ভর করে! তারা নিজেকে সমাজে বসবাসের যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারে। ছোটবেলা থেকে যারা খেলা থেকে বঞ্চিত হয় বা কারো নিয়ন্ত্রণে খেলে, তাদের ভবিষ্যতে বিষন্নতা এবং দুশ্চিন্তার সম্ভাবনা বেশি। এর জন্য অনেকাংশেই বাবা-মা দায়ী! সময় যত যাচ্ছে, বাচ্চাদের উপর স্কুলকে তত চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। পড়া শেখার চাইতে, পড়াকে ভালোবাসার চাইতে, ভাল রেজাল্ট করা কে বাবা-মা এবং স্কুল থেকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। বাচ্চারা পরীক্ষা আর রেজাল্ট নিয়ে সার্বক্ষণিক চাপের মাঝে থাকে, যে চাপের প্রবক্তাই তাদের অভিভাবকেরা! স্থান সংকুলানের কারণে অধিকাংশ স্কুলে খেলার মাঠ নেই। খেলাধুলার চাইতে অভিভাবকেরা তারা পড়লেই বেশি খুশি হন, এবং পুরস্কার দেন। ফলে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও, কখনো পুরষ্কারের লোভে অথবা প্রশংসার লোভে শিশু-কিশোরেরা ঝুঁকে পড়ছে শুধুমাত্র ভালো রেজাল্ট অর্জন করে খ্যাতি এবং অর্থের দিকে। আপনি যে কোন ছাত্র-ছাত্রীকে যদি বলেন, পড়াকে বুঝে শেখা এবং ফার্স্ট হওয়া – দু’টোর মধ্যে যেকোন একটাকে বেছে নিতে, সে কি নিবে? অবশ্যই দ্বিতীয়টা! তার এই সিদ্ধান্তের কারণ, অভিভাবক, স্কুল এবং সমাজ তাদের এভাবেই গড়ে তুলছে! দিনের বেশিক্ষণ সময় এখন বাচ্চাদের কাটাতে হয় স্কুলে, বাসায় হোমওয়ার্কের চাপ! আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এমন, যেখানে কেউ না চাইলেও তাকে হতাশ হতে বাধ্য করে! Mihaly Csikszentmihalyi ও Jeremy Hunter ৮২৮ জন ১২-১৮ বছর বয়সী শিশু-কিশোরদের মাঝে দেখেন যে, সুখ পরিমাপের স্কেলে প্রায় সবারই সুখের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি থাকে যখন তারা স্কুলের বাইরে থাকে; আর সবচেয়ে কম থাকে যখন সে স্কুলে থাকে। ছুটির দিনে সুখের পরিমাপের মাত্রা বেড়ে যায়, এবং স্কুল খোলা মাত্রই কমতে থাকে। বাবা মায়ের সাথে সময় কাটানো শিশুদের সুখ পরিমাপের স্কেলের মাঝামাঝি পড়ে, যখন সে তার সমবয়সী বন্ধুদের সাথে খেলে, তখন তা হয় সর্বোচ্চ! অভিভাবক হিসেবে সন্তানকে শিখতে উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন, ফার্স্ট হতে নয়। তার পছন্দের পেশাকে বেছে নিতে উদ্বুদ্ধ উচিত, আমাদের চাপিয়ে দেয়া উচিত নয়। আমাদের দায়িত্ব আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুপ্ত প্রতিভাকে বের করে আনা, নিজের হতাশাকে কখনোই তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *