যেভাবে চলছে সরাইল প্রাণিসম্পদ হাসপাতাল দূর্নীতির মহোৎসবে পিয়নই চিকিৎসক! প্রশিক্ষণ কক্ষই কর্মকর্তার বসতঘর!

Spread the love

মাহবুব খান বাবুল, সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিবেদক: প্রথম দিন অফিসে বসে নাসিরনগরের টেহানগরের বানা মিয়ার কাছ থেকে পশুর ব্যবস্থাপত্রের ফি ২শত টাকা নিয়ে অনিয়মের যাত্রা শুরূ করেন প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম। এরপর ভূরিভোজের বিশাল আয়োজন। নিজের ক্ষমতা ও দাম্ভিকতার বয়ান দিয়ে লোকজনকে দূর্বল করার কৌশল ব্যবহার করেন। এখন সরকারি সেবায় নেয়া হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। কৌশলে বোকা বানানো হচ্ছে গরূর খামারী ও কৃষকদের। পিয়ন শফিকই এখন চিকিৎসক। ভিজিটও  ২৫’শত থেকে ৩ হাজার টাকা। গুণে নয়, ঔষধের কদর এখন মাসোয়ারায়। ছাগল প্রকল্পের টাকা লুটপাটের বিষয়টিও চাউর হচ্ছে চারিদিকে। স্থাপনা নির্মাণ ও প্রশিক্ষণের নামে চলছে বিল ভাউছার বানানোর খেলা ও নয় ছয়। আর প্রশিক্ষণ কক্ষটিকে বাসতঘর বানিয়ে যেনতেন ভাবে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন কর্তাবাবু। মামলার তদন্ত কাজে মাসোয়ারা লেনদেনের বিষয়টি অনেকটা ওপেন সিক্রেট। তার লাগামহীন অনিয়ম দূর্নীতির বিরূদ্ধে ফুঁসে ওঠেছিল সাবেক কর্মস্থল নবীনগরের লোকজনও। অনুসন্ধানে ও সরজমিনে ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. জাহাঙ্গীর আলম। সরাইলে যোগদান করেছেন ২০১৯ সালের ৯ অক্টোবর। যোগদানের পরই বিশাল ভূরিভোজের আয়োজনে মাতিয়ে তুলেন হাসপাতাল। যাত্রা শুরূ করেছেন তিনি অনিয়মের মাধ্যমে। নিয়ম না থাকলেও অফিসে বসে নাসিরনগর উপজেলার টেহানগরের বানা মিয়ার কাছ থেকে ২শত টাকা নিয়ে পশুর চিকিৎসা দেন। কৌশলে ভাব জমাতে থাকেন ঔষধ কোম্পানির এম আর’দের সাথে। মান নয়। মাসোয়ারায় ব্যবস্থাপত্রে ঔষধের নাম লিখার বিষয়টি চাউর হচ্ছে সর্বত্র। সরকার ঘোষিত নিষিদ্ধ ঔষধ লিখছেন দেদারছে। নিজের বাণিজ্য চাঙ্গা করতে গ্রাম্য পশু চিকিৎসকদের উপর খড়গ চালানোর অভিযোগ ওঠেছে উনার বিরূদ্ধে। কিছু জায়গায় ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনার হুমকিও দিচ্ছেন। সরকারি ভ্যাকসিন নিয়ে করছেন তেলেছমতি। গ্রাম এলাকায় দালালের সহায়তায় বড় গ্রƒপ তৈরী করে তারপর ইচ্ছেমত টাকা নিয়ে ভ্যাকসিন দিচ্ছেন। গ্রƒপ না হলে ঘুরাচ্ছেন। গত ১৮ মার্চ সূর্যকান্দি গ্রামের সুজনের ১৬টি গরূকে খোড়া রোগের ভ্যাকসিন দিয়ে (১৬*১০=১৬০ টাকা) ১৬০ টাকার স্থলে ৮ শত টাকা আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অফিসে থেকেও জাতীয় দিবসের কর্মসূচি এড়িয়ে চলার বিষয়টিও চাউর হচ্ছে। বাড়িতে পশুর চিকিৎসায় অধিক মনযোগি তিনি। কর্তার  লাভের জন্য পিয়নই এখন বড় চিকিৎসক। গাভীর কৃত্রিম প্রজনন (বীজ প্রদানের) প্রদানের দায়িত্ব শঙ্করের। বাহিরের কলের জন্য শঙ্করও হাসপাতালে সময় দিতে পারছেন না। অফিস ফাঁকা করে এ আই কর্মী শঙ্কর ও পিয়ন শফিককে চিকিৎসার জন্য পাঠান লোকজনের বাড়িতে। আর ভিজিটের টাকার বড় অংশ নেন কর্তা বাবুরা। বাড়িতে কলের ভিজিট ৩ হাজার টাকা। গ্রাম এলাকা থেকে কোন অসুস্থ্য পশু নিয়ে আসলে উনার নিয়মিত উক্তি, “অবস্থা খুবই খারাপ। মারাও যেতে পারে। চিকিৎসা দিতে হবে বাড়িতে গিয়ে।” চিকিৎসকের কথায় ঘাবড়ে যায় পশুর মালিক। চোখ বন্ধ করে টাকা খরচ করেন। শাহজাদাপুরের হিরা মিয়ার বিরূদ্ধে একটি মামলা করেছিল স্থানীয়রা। তদন্তের দায়িত্ব পান জাহাঙ্গীর আলম। হিরা মিয়ার পক্ষে প্রতিবেদন দিতে মাসোহারা নেন ৫ হাজার টাকা। খোরা রোগের সরকারি ভেকসিনের মূল্য ১০ টাকা। অথচ শাহজাদাপুরে ভেকসিনের জন্য ছাগল ৫০ ও গরূ প্রতি ১ শত টাকা নেয়া হয়। ২০২০ সালে গরূ মোটাতাজাকরণ বিষয়ে খামারীদের প্রশিক্ষণ বাবদ সরকারি বরাদ্ধ আসে ১ লাখ ৩২ হাজার টাকা। পিপিআর ও খোরা রোগ বিষয়ে ৯ জন স্বেচ্ছাসেবীর প্রশিক্ষণ বাবদ ৩৭ হাজার ৭ শত টাকা। ছাগল পালন প্রশিক্ষণ ও খাবার বাবদ ৫৮ হাজার ৮ শত টাকা। ছাগলের মেলার আয়োজন বাবদ ৫০ হাজার ৬ শত টাকা। এর মধ্যে ২ জন ছাগল পালনকারীকে ২০ হাজার টাকায় ২টি টেলিভিশন, ১ জনকে ১০ হাজার টাকায় ১টি শেড ও অবশিষ্ট টাকায় র‌্যালি করার কথা। মহিষ পালন প্রশিক্ষণ বাবদ ১ লাখ ২৭ হাজার টাকা ও অফিসের পাশে অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ বাবদ এসেছে ১ লাখ টাকা। সর্বমোট বরাদ্ধ ৫ লাখ ৬ হাজার টাকা। কিছুই হয়নি এখনো। জুনের ১০ তারিখের আগেই প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা জাল স্বাক্ষরে ভূয়া বিল ভাউচার জমা দিয়েছেন হিসাবরক্ষণ অফিসে। ৩০ জুনের মধ্যে উত্তোলন করে নিবেন ৫ লক্ষাধিক টাকা। ২০১৯ সালের জুন মাসে ছাগল প্রকল্পের ৫৫ হাজার টাকা আসে। ওই টাকা উত্তোলন করে গায়েব করে ফেলার অভিযোগও ওঠেছে ওই কর্মকর্তার বিরূদ্ধে। এর পর আরো দুইবারে ১ লাল ১০ হাজার টাকা আসার কথা। সেইটারও কোন শব্দ নেই।  গত ১ মার্চ ক্ষমতাপুর গ্রামের খামারীদের কাছে পিয়ন শফিককে দিয়ে ২৫ পয়সা মূল্যের ভেকসিন ৩০ টাকা করে বিক্রি করেন ১৬৬ জনের কাছে। ছাগল পালনের শেট ও অন্যান্য সেবা বাবদ সরকারি বরাদ্ধ ৫৪ হাজার টাকা গায়েব করে ফেলেছেন। পানিশ্বরের যুবলীগ নেতা সজু জানান, তার সিন্ধি জাতের একটি গাভী পেটে গ্যাস হয়ে খাবার বন্ধ হয়ে যায়। জাহাঙ্গীর স্যারকে ফোনে জানালে তিনি পিয়ন শফিককে পাঠান। শফিক গাভীটি দেখে ২-৩ প্রকারের ঔষধ দেয়। আর ভিজিট দিতে হয়েছে ২২ শত টাকা। পরের দিন সকাল সাড়ে ৮টায় গাভীটি মারা যায়। জবাইয়ের পূর্বে পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাবদ নেয়া হচ্ছে টাকা। সরাইল বাজারের কসাই রফিক মিয়াসহ অনেকে জানায়, পরীক্ষার জন্য ৫০/১০০/২০০ টাকা দিতে হয়। পানিশ্বর ইউনিয়নের শাখাইতি গ্রামের কৃষক মো. বাছির মিয়া অভিযোগ করে বলেন, গরূর খোড়া রোগের চিকিৎসার লাইগ্গা আইছিলাম। বড় ডাক্তর জাহাঙ্গীর স্যার ৭ টা গরূর জন্য ১৫’শ টেহা চাইছে। গত বছর ১৫০ টেহা দিয়া ১২ডা গরূরে ইনজকশন করছি। গরীব মানুষ। চাষাবাদ কইরা হাই। আমডা গরীব মানুষ। এত টেহা দিমু কইত্ত¡াইক্কা? এই অবস্থা অইলে যামু কই। অহন হুব টেনশনে আছি। হাসপাতালের অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণ কক্ষকে বানিয়ে নিয়েছেন নিজের বসতবাড়ি। একপাশে ফেলেছেন খাট। জায়গা করে রেখেছেন কাপড়-ছোপর। ভাত তরকারির পাতিল ও প্লেট দিয়ে সাজিয়েছেন ওই কক্ষটি। প্রশিক্ষকের টেবিলটি এখন উনার ডাইনিং টেবিল। নিয়মিত ব্যবহার করছেন ওই কক্ষের চেয়ার গুলিও। বারান্দায় দিনরাত ছড়িয়ে রাখেন ভেজা কাপড়। সকাল বিকাল খালি গায়ে ঘুরেন প্রশিক্ষণ কক্ষের বারান্দায়। একই ভবনের দ্বিতীয় তলায় থেকেও অফিস কক্ষে আসেন ১১টায়। জয়ধরকান্দি গ্রামের এক ভুক্তভোগীর নাম তাকমিনা বেগম (২০)। গত বছরের ২৩ অক্টোবর আজগর আলীসহ ৫ জনের বিরূদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন ট্র্যাইব্যুনালে-২ এ মামলা করেছিলেন। আদালত ৭ কার্য দিবসের মধ্যে তদন্তের দায়িত্ব দেন সরাইল উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তাকে। তাকমিনা জানায়, ২০ নভেম্বর তিনি বাদী পক্ষকে নোটিশ দেন। ২৫ নভেম্বর উনার দফতরে হাজির হইয়া বাদীসহ ৬ জন জবানবন্দি প্রদান করেন। তবে শুনানীর শুরূতেই তিনি আসামীদের পক্ষ অবলম্বন করেন। তদন্ত প্রতিবেদনে স্বাক্ষর করেন ২০২০ সালের ৯ জানুয়ারি। ২২ জানুয়ারি উনার প্রতিবেদনের উপর অনাস্থা দেন বাদীনি। বাদীনির অভিযোগ জাহাঙ্গীর আলম প্রতিবেদন জমা দিতে বাদীনির কাছে অনৈতিক প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবে সম্মত না হলে মিথ্যা রিপোর্ট দেওয়ার হুমকি দেন। সেই জন্য জাহাঙ্গীর আলমকে তদন্তের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করেন। অভিযোগটি আমলে নেয় আদালত। ওইদিনই সরাইল উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা ফাতেমা বেগমকে মামলাটি নতুন করে তদন্তের দায়িত্ব দেন। তিনি তদন্ত করে বাদীনির অভিযোগের সত্যতা পেয়ে সকল আসামীর বিরূদ্ধে প্রতিবেদন জমা দেন। আসামীদের বিরূদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোাানা জারি হয়। পানিশ্বর গ্রামের আ. হান্নান বলেন, ছাগল পালন প্রকল্প শুরূ হয়েছে ২০১৯ সালের জুন মাস থেকে। তবে কাউকে এখনো শেড নির্মাণ ও খাবার দেওয়া হয়নি। শাহবাজপুর গ্রামের মো. এনাম মিয়া জানান, প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তার দফতর থেকে গ্রাম এলাকায় শঙ্কর শফিকরা পশুর চিকিৎসা করতে আসেন। তাদের ভিজিট সর্বনি¤œ ১ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা। বাছুর প্রসবের ফি দিতে হয় ৩-৫ হাজার টাকা। সূত্র জানায়, নবীনগরে চাকরিকালীন সময়ে অনিয়ম দূর্নীতিতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেছিলেন এই জাহাঙ্গীর আলম। তাঁর অনিয়মের বিরূদ্ধে লিখিত অভিযোগ হয়েছিল। তদন্তে গিয়েছিলেন তৎকালীন জেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডা. বজলুর রশিদের নেতৃত্বে একটি টীম। ঘটনাস্থলে যাওয়ার পরই ফুঁসে ওঠেন স্থানীয়রা। তারা প্রকাশ্যে জাহাঙ্গীর আলমের বিরূদ্ধে মিছিল করতে থাকেন। থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এসে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে তাকে রক্ষা করেন। এ ঘটনায় ক্ষুদ্ধ হয়ে সেখানকার কম্পাউন্ডার ও ডিএফএ-বজলুর রহমানের সার্ভিস বুকে লাল কালি দিয়ে যা-ইচ্ছে তাই লিখে দিয়েছেন। চতুর্থ শ্রেণির এ দুই কর্মচারী চাকরি শেষে তাঁর ওই লেখার জন্য পেনশন পাবেন না। এ বিষয়ে তারা জাহাঙ্গীর আলমের বিরূদ্ধে মামলাও করেছিলেন। প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম সকল অভিযোগকে মিথ্যা আখ্যায়িত করে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, রেজিষ্টার্ড চিকিৎসকের নির্দেশ বা পরামর্শ ছাড়া চিকিৎসা অসম্ভব। তবে জানা থাকলে যে কেউ ইনজেকশন বা ভেকসিন পুশ করতে পারেন। হাসপাতালে পশু চিকিৎসায় কোন ভিজিট নেয়া হয় না। মানবতাবোধ থেকে যদি কেউ কিছু করেন সেটা ভিন্ন কথা। বাড়িতে চিকিৎসা দিয়ে কর্তৃপক্ষের কথা বলে টাকা আনার প্রমাণ পেলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিব। প্রশিক্ষণ কক্ষে বসবাসের বিষয়টি সঠিক নয়। এটাকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়।  জেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডা: মো. সাইফুজ্জামান বলেন, অফিস চলাকালীন সময়ে হাসপাতালে বসে ভিজিট নিয়ে পশুর চিকিৎসা দেয়া আর ভেকসিনের অতিরিক্ত মূল্য নেয়ার কোন বিধান নেই। বাড়িতে গিয়ে পশুর চিকিৎসা দিলে মানবিক দিক বিবেচনায় কেউ ভদ্রতা করলে সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু চাপিয়ে ১/২/৩ হাজার টাকা আনা অন্যায়। আর প্রশিক্ষণ কক্ষে কর্মকর্তা বসবাস করতে পারেন না। ছাগল প্রকল্পের পিডি মো. শরীফ উদ্দিন বলেন, প্রকল্পের কাজ পক্রিয়াধীন আছে। প্রকল্পভুক্ত সকলেই শেড ও খাবার পাবে। কোন সমস্যা হলে আমরা দেখব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *