মুরাদনগরে অসহায় মা-মেয়ের পাশে দাঁড়ালেন মানবসেবায় মি. ফান

Spread the love

মাহবুব আলম আরিফ, মুরাদনগর প্রতিবেদক:

জাহানারা বেগম (৫৫)। প্রায় ৪০ বছর আগে পারিবারিকভাবে কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার মোচাগড়া গ্রামের নাগোর আলীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ভেবেছিলেন স্বামীর সংসারে বেশ সুখেই দিন কাটবে তার। কিন্তু না! স্বামীর ভালো কোন কাজ না থাকায় সংসারের টানাপোড়ন যেন তার পিছু ছাড়েনি। সংসার জীবনে জন্ম দিয়েছেন তিনটি পুত্র ও একটি মেয়ে সন্তান তবে মা ডাক শুনার আগেই দাফন করতে হয়েছে তিন ছেলেকেই। পুত্র সন্তানদের মৃত্যুর পর একমাত্র মেয়ে মর্জিনা আক্তারকে বুকে আগলে রেখে সুন্দর ভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখেন তিনি। সেই স্বপ্নেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় স্বামীর চলে যাওয়া। মেয়ের জন্মের কিছুদিন পরেই মৃত্যুবরণ করেন স্বামী নাগোর আলী।

জীবন যুদ্ধে হাড় না মানা জাহানারা বেগম তার পর থেকে স্বপ্ন দেখা শুরু করেন মেয়ে মর্জিনাকে নিয়ে। ভেবেছিলেন ভালো একটা ছেলে দেখে মেয়ে মর্জিনাকে বিয়ে দিলে হয়তো সে স্বামী সংসার নিয়ে সুখেই থাকবে। জাহানারা বেগমের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে প্রায় ৮ বছর আগে আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশিদের সহযোগিতা মেয়ে মর্জিনাকে বিয়ে দেয়া হয় একই উপজেলার সিংহারিয়া গ্রামের কুদ্দুছ মিয়ার ছেলে সোহেলের সাথে। বিয়ের পর থেকে সোহেল কোন ভাবেই মর্জিনাকে মেনে নিতে পারছিলোনা। এরই মাধ্যে তাদের সংসারে একটি পুত্র সন্তানের আগমন ঘটে। বাবা হওয়ার খবর শুনে খুশি না হয়ে উল্টো স্ত্রী সন্তান কে ফেলে রেখে অন্য এক মেয়ের হাত ধরে পালিয়ে যায় সোহেল। স্বামীর অনুপস্থিতি আর শশুর শাশুরির মানসিক নির্যাতন সইতে না পেরে ছেলে সোহাগকে নিয়ে চলে আসেন হতভাগি মা জাহানারা বেগমের কাছে। মেয়ে আর নাতির অধিকার আদায়ের জন্য বহু চেষ্ট করেও তা সম্ভব হয়নি জাহানারা বেগমের। এরই মধ্যে টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে যাওয়ার পথে মেয়ে মর্জিনার। নিজেই যেখানে খাবারের জন্যে মানুষের ধারে ধারে গিয়ে হাত পাততে হয় সেখানে সংসারে যুক্ত হয়েছে মেয়ে ও নাতি। কি আর করার ভাগ্যের এই নির্মম পরিহাস তো মেনে নিতেই হবে। মেয়ে আর নাতিকে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে খুব কষ্টে দিন পার করছিলো জাহানারা বেগম। সেখানেও ভাগ্য তার সঙ্গ দেয়নি সংসারে নতুন করে আঘাত হানে শিলা বৃষ্টি। গত দু’মাস আগে শিলা বৃষ্টির কারণে মা মেয়ের থাকার ছোট্ট ঘরটির সকল টিন ফুটো হয়ে যায়। সামান্য বৃষ্টি হলেই ঘরে থাকা অসম্ভব হয়ে যায় তাদের। মা-মেয়ের এমন অবস্থা দেখেও আশপাশের আত্মীয়-স্বজন জনপ্রতিনিধি কিংবা এলাকার বিত্তশালীরা এগিয়ে আসেনি কেউ।

অপরদিকে যে বয়সে বাবা-মার কাছ থেকে হাত খরচ নিয়ে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ানোর কথা, সেই জায়গায় এক ঝাঁক তরুণ মানবসেবায় মি. ফান নামক একটি সংগঠন তৈরি করে। আর সেখান থেকে সমাজের অসহায় মানুষদের কে সাধ্যমত সহযোগিতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। সংগঠনের সদস্য মোচাগড়া গ্রামের আলমগীর হোসেনের কাছ থেকে জাহানারা বেগমের এমন করুণ পরিস্থিতির কথা শুনে সকল সদস্যরা দ্রæত চলে যায় তার বাড়ী। সেখানে গিয়ে যখন তারা দেখে ঘরের মেরামত করাতো দুরের কথা দু’মুঠো ভাত যোগার করতেই কষ্ট হয় জাহানারা বেগমের। তখনই জাহানারা বেগম ও তার মেয়ের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় তারা। শুরু হয় দেশে ও বিদেশে থাকা সংগঠনের সকল সদস্যদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহের কাজ। তারই ধারাবাহিকতায় গত এক সপ্তাহের প্রটেষ্টায় ৩৫ হাজার ৫শত টাকা ব্যয়ে একটি নতুন ঘর তৈরি করে মঙ্গলবার দুপুরে জাহানারা বেগম ও তার মেয়েরে হাতে তুলে দেয়া হয় সেই ঘরের মালিকানা। পাশাপাশি মা-মেয়েকে থাকার জন্য কিনে দেয়া হয় একটি নতুন চৌকি, তোষক, বালিশ ও বিছানার চাদর। আর সেই স্বপ্নের কুটিরের নাম দেয়া হয়েছে ‘ছায়ানীড়’। তাদের এমন উদ্যোগকে সালাম জানিয়েছে এলাকার সচেতন মহল। বিষয়টি এলাকায় জানাজানি হলে সংগঠনের সাথে জড়িতদের বাবা-মাও যেন এখন গর্ববোধ করছে তাদের সন্তানকে নিয়ে।

ইতিমধ্যে, এলাকায় বেশ কিছু প্রশংসনীয় কাজ করেছে তারা অসুস্থ মানুষকে চিকিৎসা সেবা দেয়া, শীতবস্ত্র বিতরণ, নিম্ন আয়ের মানুষের মাঝে খাদ্য সামগ্রী বিতরন, এতিম ছাত্রদের পোশাক প্রদানসহ জরুরি প্রয়োজনে অসুস্থ ব্যক্তিদের নিজ খরচে রক্ত প্রদানও করে আসছে সংগঠনের সদস্যরা।

ঘর পেয়ে জাহানারা বেগম বলেন, এখন মনে হইতাছে মাটির নিচে দাফন করা তিন ছেলে আমার আবার ফিরা আইছে। দোয়া করি আল্লাহ তাগোর মঙ্গল করুক। দোয়া ছাড়া তাগোরে আমার আর কি বা দেয়ার আছে স্যার।

সংগঠনের সদস্যদের সাথে কথা হলে তারা জানান, আমরা চাই মানব সেবার মাধ্যমে আমাদের আশপাশের সকলকে নিয়ে ভালো থাকতে। তাই সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। আমাদের পাশাপাশি যদি সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসে তাহলে এ ধরণের কাজ করাতে আরো সহজ হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *