সরাইলে খুঁটি বাণিজ্যে বেপরোয়া পিডিবি’র ঠিকাদার
মাহবুব খান বাবুল, সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) থেকে: সারা বাংলাদেশের ন্যায় সরাইলেও চলছে ‘বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা উন্নয়ন প্রকল্প’ এর কাজ। জরাজীর্ণ, পরিত্যাক্ত লাইন ও খুঁটি অপসারণ করে নতুন ভাবে স্থাপন এ কাজে অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা। ১ কোটি ৭০ লাখ টাকার এ কাজটি করছেন ‘ট্রেড পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল’ নামের একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। কার্যাদেশ অনুযায়ী শুধু সরাইলেই ২ হাজার ৭ শত বৈদ্যুতিক খুঁটি ও ৩০-৪০ টি ট্রান্সফরমার বসানোর কথা। বিনা মূল্যে কন্সালটেন্টের ডিজাইন অনুসারে কাজ হবে এটাই বিধান। কিন্তুু ডিজাইনের তোয়াক্কা না করে সরাইলে খুঁটি বাণিজ্যে বেপরোয়া এখন পিডিবি’র ঠিকাদার। দর কষাকষি করে মোটা অংকের টাকা আদায় করে দিচ্ছেন খুঁটি। অর্থাভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রকল্পভূক্ত গ্রাম গুলোর গ্রাহক। সংশ্লিষ্টদের অনুমতি ছাড়াই দেদারছে কাটছেন সড়কের পাশের গাছ। প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন স্তরকে ম্যানেজ করেই ঠিকাদারের অনিয়মের বিষয়টি চাউর রয়েছে এলাকায়। যেখানে টাকা সেখানেই খুুঁটি। পাঁচ-আট মাস পরও খুঁটিতে ক্যাবল না লাগায় ক্ষুদ্ধ গ্রামবাসী।
সরজমিন অনুসন্ধানে ও ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ওই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মালিক আবুল কালাম হাজারী। ঢাকার ৭০/ ডি গ্রীনরোডের এম এস ভবনের পঞ্চম তলায় তাদের কার্যালয়। সরাইলে সরাসরি কাজটি বাস্তবায়ন করছেন কালাম হাজারীর ভাই সোলেমান হাজারী। কাজটির সুপারভাইজার মো. আতিকুজ্জামান সোহেল। এর আগে সরাইলে বিদু্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য ২ থেকে আড়াই বছর মাঠে থেকে ডিজাইন করা হয়েছে। সেই ডিজাইনের কন্সালটেন্ট আব্দুস সালাম এখনো সরাইলেই অবস্থান করছেন। নিয়ম হচ্ছে ওই ডিজাইন অনুসারে খুঁটি ও ট্রান্সফরমার বসাবেন ঠিকাদার। কিন্তু সরকার বা সংশ্লিষ্ট দফতরের উদ্যেশ্যের সাথে মিলছে না ঠিকাদারের কর্মকান্ড। তারা একটি খুঁটির জন্য গ্রাহকদের কাছ থেকে ১০-১২ হাজার করে টাকা নিচ্ছেন। ক্ষেত্র বিশেষ আরো বেশী। খুঁটি বিক্রির প্রকল্প বাগিয়ে আনার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে কিছু দালালও তৈরী করেছেন। সরকারের দেওয়া ফ্রি খুঁটি ও ট্রান্সফরমার নিয়ে সরাইলে রীতিমত লাখ লাখ টাকার বাণিজ্যে মাতোয়ারা এখন ঠিকাদার। ডিজাইনের ধারে কাছেও নেই তারা। যারা টাকা দিচ্ছেন তারাই খুঁটি পাচ্ছেন। টাকার কাছে পরাজিত হচ্ছে প্রয়োজনীয়তাও। বরাদ্ধ অনুপাতে সরাইলের জন্য এলটি (‘ল’ টেনশন) খুঁটি রয়েছে ১ হাজার ৫শত টি। আর এইচটি (হাই টেনশন) খুঁটি রয়েছে ১ হাজার ২ শত টি। ট্রান্সফরমার রয়েছে ৩০-৪০ টি। সরাইল সদরের সৈয়দটুলা, মোগলটুলা, গড়েরপাড় ও হাফিজটুলা এলাকায় খুঁটি বাণিজ্যের বিষয়টি সকলের মুখে। হাফিজটুলার (বন্দের হাটি) ছোটন মিয়া (৪৫), নেহেরা বেগম (৪৭) ও রানু আক্তার (৩২) সহ অনেকে বলেন, ১৪টি খুঁটির মূল্য ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। অর্ধেকের বেশী টাকা দিয়েছি। ৫ মাস হয়েছে। ক্যাবল লাগেনি। বাঁশের খুঁটিতে লাইন। খুবই কষ্টে ও নিরাপত্তাহীনতায় আছি। সরাইল-পানিশ্বর সড়কের গড়ের পাড় (পশ্চিম পাড়) এলাকায় দেখা যায় বেশ কয়েকটি এইচটি খুঁটি পাশের খালে পড়ে আছে। আব্দুল মন্নাফ (৬৫) ও নূর মোহাম্মদ (৬০) বলেন, খুঁটির জন্য বেশী না দেড়-দুই হাজার টাকা করে দিয়েছি। বন্দের হাঁটির বাসিন্দা ভ্যানচালক কালাম মিয়া বলেন, আমরা ৪ ভাই। কাজ কাম করে সংসার চালায়। বৈদ্যুতিক খুঁটির জন্য সকলে মিলে ৩-৪ হাজার টাকা দিয়েছি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় জনৈক যুবক বলেন, সাঘরদীঘির পাড় এলাকায় খুঁটির জন্য দেড়-দুই শতাধিক পরিবারের প্রত্যেকের কাছ থেকে দেড় হাজার টাকা করে নিয়েছে। শাহবাজপুরের পোষ্ট অফিস পাড়া, হিন্দু পাড়া ও আতকা বাজার এলাকায় ৪ শত খুঁটি বসানো হয়েছে। প্রত্যেক খুঁটির জন্য নিয়েছেন ১০ হাজার টাকা। এক এলাকা থেকেই কামাই করলেন ৪০ লাখ টাকা। ফুল মিয়া জানায়, শুধু একটি খুঁটির জন্য ১৫ হাজার টাকা দাবী করেছে। ১০ হাজার টাকা দিয়ে খুঁটি পেয়েছেন। বাকী ৫ হাজার টাকা দিলে ক্যাবল দিবেন। পল্লী চিকিৎসক অজয় জানান, তিনটি খুঁটি পেতে দিতে হয়েছে ২০ হাজার টাকা। আট মাস পরও ক্যাবল লাগেনি। একই এলাকার মুসা মিয়া বলেন, পাঁচটি ছোট খুঁটির জন্য ২০ হাজার টাকা দিয়েছি। ক্যাবল লাগানোর সময় আরো টাকা দিতে হবে। আতকা বাজার এলাকার মসজিদ কমিটির সভাপতি মো. নূর হোসেন বলেন, মসজিদ ও বাড়ির জন্য ৩টি খুঁটি চেয়েছিলাম। ঠিকাদার চেয়েছে ৯ হাজার টাকা। টাকা দেয়নি। তাই খুঁটি বসানো হয়নি। আবার শুনি সরকার ফ্রি দিয়েছেন। স্থানীয় ইউপি যুবলীগ নেতা মামুন মিয়া আক্ষেপ করে বলেন, আমরা জানি বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রাম এলাকার বিদ্যুৎ উন্নয়নের জন্য এ গুলো ফ্রি দিয়েছেন। অথচ ৫-১০ হাজার টাকার কমে কাউকে খুুঁটি দিচ্ছেন না ঠিকাদার। এতে করে বদনাম হবে সরকারের। শাহজাদাপুুর ইউনিয়নের দেওড়া গ্রামে জনৈক ব্যক্তির অনুরোধে ১৭টি খুুঁটি পাঠানো হয়। টাকা না দেওয়ায় গভীর রাতে ওই খুঁটি গুলি নিয়ে আসেন ঠিকাদার। চুন্টায় বড়বুল্লা সড়কে ৬টি খুঁটি বসানোর জন্য নিয়েছেন ৫০ হাজার টাকা। ওই ইউনিয়নের আরো ২-১ জায়গায় খুঁটি বসিয়ে বাণিজ্য করেছেন। কাউকে না জানানোর শর্তে কালিকচ্ছের মো. ইব্রাহিমকে ৮টি ছোট খুঁটির জন্য গুনতে হয়েছে ৪০ হাজার টাকা। পাঁচটি খুঁটির জন্য কালিকচ্ছ বাজারের ব্যবসায়ি মো. হামিদ উল্লাহর কাছে সুপারভাইজার মো. আতিকুজ্জামান সোহেল নিজে চেয়েছেন ১ লাখ টাকা। সরাইল পিডিবি অফিস সংলগ্ন বড় দেওয়ান পাড়ার বাসিন্ধারা দীর্ঘদিন ধরে ঘুরছেন জরাজীর্ণ পরিত্যাক্ত পর্যায়ের কয়েকটি খুঁটি বদলের জন্য। টাকার চুক্তি না হওয়ায় তাদের বিষয় আমলেই নিচ্ছেন না ঠিকাদারের লোকজন।
প্রকল্পভুক্ত গ্রামে যায়নি খুঁটি: মূলত: ল-বুল্ডেজ সমস্যার সমাধান ও গাছের ডালপালা থেকে বিদ্যুতের লাইন অপসারণ করতেই সরাইলে সরকারের এই প্রকল্প। প্রকল্পের আওতাভুক্ত উল্লেখযোগ্য গ্রাম গুলোর মধ্যে নোয়াগাঁও ইউনিয়নের কাটানিশার, আখিঁতারা ও কাজিউড়া। চুন্টার বড়াইল। কালিকচ্ছের চানপুর। পানিশ্বর ইউনিয়নের টিঘর ও বিটঘর। বছরের পর বছর ল-বুল্ডেজ সহ বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছিল ওই গ্রাম গুলোর গ্রাহকরা। তাদের এই সমস্যা সমাধান করে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিত করার লক্ষেই এই প্রকল্প এসেছে সরাইলে। কিন্তু ওই গ্রাম গুলোতে এখনো পৌঁছেনি বিদ্যুতের খুঁটি। অথচ টাকার বিনিময়ে প্রকল্পের বাহিরের অনেক এলাকায় দেদারছে বসছে খুঁটি।
সরকারের বাচাইকৃত গ্রামেও বাণিজ্য: দেশের প্রত্যেক উপজেলায় সরকার একটি গ্রাম বাচাই করেছেন। ওই গ্রামের আনাচে কানাচে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে পরিচ্ছন্ন ভাবে বিনামূল্যে বিদ্যুতায়নের কথা বলা আছে। সরাইলের সেই গ্রামটি হচ্ছে কুট্রাপাড়া। সেখানে বিদ্যুতের কাজে একটি টাকা নেয়ার বিধান না থাকলেও ঠিকাদারের লোকজন ব্যাপক বাণিজ্য করছেন। পশ্চিম কুট্রাপাড়া এলাকার আশরাফ নিয়েছেন ৭-৮টি খুঁটি। প্রত্যেক খুঁটির জন্য তার কাছ থেকে ৬ হাজার টাকা আদায় করার বিষয়টি চাউর হচ্ছে গোটা সরাইলে। এছাড়া একই গ্রামের জ্বীনহাটি সহ আরো কয়েকটি মহল্লার গ্রাহকদের টাকা দিয়ে খুঁটি নিতে হয়েছে। কুট্রাপাড়া গ্রামের বাসিন্ধা আওয়ামীলীগ নেতা মো. মাহফুজ আলী বলেন, সরকারের নির্দেশ অমান্য করে কিছু দালালের মাধ্যমে কুট্রাপাড়া গ্রাম থেকে মোটা অংকের টাকায় খুঁটি বাণিজ্য করছে ঠিকাদারের লোকজন। এটা উন্নয়মূখী সরকারকে কলংকিত করার একটা গভীর ষড়যন্ত্র।
কন্সালটেন্ট মো. আব্দুস ছালাম বলেন, কিছু ক্ষেত্রে ডিজাইন মানছেন না ঠিকাদার। আমি এ বিষয়ে শুরূতেই পিডি’র কাছে লিখিত অভিযোগ করেছি। এর বেশী কিছু আমি করতে পারি না। ঠিকাদারের নিয়োগকৃত প্রকৌশলী মো. আতিকুজ্জামান সোহেল আমাকে নিয়মিত কাজের আপডেট জানান। এ বিষয়ে সুপার ভাইজার প্রকৌশলী মো. আতিকুজ্জামান সোহেল মুঠোফোনে বলেন, খুঁটি বা ক্যাবলের জন্য গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নেয়ার কোন বিধান নেই। টাকা আদায় করে খুঁটি দেয়া হয়েছে এমন ২-৩টি জায়গার উল্লেখ করলে তিনি বলেন, শ্রমিকদের চা পানির জন্য কেউ খুশি হয়ে কিছু দিয়ে থাকতে পারেন। আমি টাকা পয়সা নেয়নি। কারো কাছে চাইনি। আর সোহেল নামের আরেকজন এখানে কাজ করছেন।