মাওলানা সাইয়্যিদ শাহবাজ মুহাম্মদ ভাগলপুরী (রহঃ)-

Spread the love

পর্ব-৩

কথিত আছে, একদা তিনি হাদিসের কিতাব মিশকাত শরীফের দারস দিচ্ছিলেন, এমতাবস্থায় যখন তিনিالحياءشعبةمنالايمانএর হাদিস পড়াতে আরম্ভ করেন, তখন হযরতের নিকট যে ছাপা ছিল, তাতে “মিন” এর স্থলে “মিন”ই লেখা ছিল তবে ছাত্রদের কিতাবের ছাপায় “মিন” এর স্থলে “হিয়া” লেখা ছিল, এজন্যে তারা বারংবার মিন এর স্থলে হিয়া পড়ছিলেন। সুলতানুল আরিফিন এমন অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের মাঝে কি এমন কেউ রয়েছে যে সরাসরি দয়াল নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট হতে সঠিক লেখাটি জানতে পারবে ?” তখন ছাত্রগণ সম্মিলিত কন্ঠে উত্তর দিলেন “ হে শাইখ, এ মর্যাদা আপনার জন্যই নির্দিষ্ট। এরপর সুলতানুল আরিফিন কিছুক্ষণ নিরব থেকে দীর্ঘ মুরাকাবায় মগ্ন হন, কোন কোন বর্ণনায় রয়েছে , তিনি অর্ধদিবস যাবৎ মুরাকাবায় মগ্ন থেকে পুরো মিশকাত শরীফ নবীয়ে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট হতে শুদ্ধ করিয়ে নেন।

তাকওয়া ও পরহেজগারী- হুজুর সুলতানুল আরিফিন আহকামে শরীয়ত ও সুন্নাতে নববী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম পালনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। কোন ব্যক্তি তাঁর সামনে সুন্নাত ত্যাগ করে অন্য কোন পন্থা অবলম্বন করলে হযরত কক্ষনও তাতে বাধা দান করতেন, এবং এ ব্যাপারে তিনি আপন বা পরের কোন খেয়াল করতেন না।

হুযুর সুলতানুল আরিফিনের দরবারে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের আগমন- বাদশাহ জাহাঙ্গীর এর মৃত্যুর সময় যখন ঘনিয়ে এলো, তখন বাদশাহ শাহজাহানের সৎ মা নুরজাহান শাহজাহানের বিরুদ্ধে সম্রাট জাহাঙ্গীর কে উস্কানিমূলক কথা বলে শাহজাহানের বিরুদ্ধে ক্ষুন্ধ করে তোলেন যাতে করে তাঁর মৃত্যুর পর সম্রাট শাহজাহানের পরিবর্তে তাঁর পূর্বের স্বামী শের আফগানের সন্তানকে সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী বানানো হয়। শাহজাহানের বিরুদ্ধে তাঁর সৎ মায়ের এ চক্রান্তের ফলে শাহজাহান তাঁর ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ ছিলেন এবং এমতাবস্থায় নিরুপায় হয়ে ১০৩৫ হিজরীতে শাহজাহান রাজমহল নামক স্থান হয়ে ভাগলপুরের পূন্যভূমিতে হুযুর সুলতানুল আরিফিনের খিদমতে উপস্থিত হন। অতঃপর অত্যন্ত আদব ও বিনয়ের সহিত হযরতের দরবারে সমস্ত অবস্থা বর্ণনাপূর্বক আরজি পেশ করলেন এবং বললেন, “ যদি আপনার দুআ ইচ্ছা করে , তবে আমাকে সিংহাসন ও মুকুট দান করতে পারে এবং বাদশাহে পরিণত করতে পারে, নতুবা এ ছাড়া আর কোন তদবীর দেখছিনা”।

জবাবে হুযুর ইরশাদ করলেন, “তুমি চাও, যে তোমাকে হিদুস্তানের বাদশাহী দান করা হোক, অথচ তোমার জুব্বার আঁচলজমিন স্পর্শ করছে যা কিনা শরীয়তে মুস্তাফাভী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম এর বরখিলাফ, বাদশাহ যখন শরীয়ত এর আনুগত্য করেনা, তখন তাঁর অধিনস্তরা শরীয়তের বিরুদ্ধে চলে যায়”। হুযুরের এ হুকুম শোনার পরপরই শাহজাহান তাঁর জুব্বার আঁচল ছিড়ে ফেলে দিতে লাগলো, এ দৃশ্য দেখা মাত্র হুযুর ইরশাদ করলেন, “কাপড় ফেলে দিয়ে অপচয় করোনা বরং, এটা ছাত্রদের দিয়ে দাও, তারা এটা দিয়ে টুপি বানিয়ে নেবে”, শাহজাহান যখন হুযুরের আদেশ যাথাযথভাবে পালন করলো তখন তাঁর শরীয়তের আনুগত্য হুযুরকে আনন্দিত করলো, এরপর শাহজাহান হুযুরকে জিজ্ঞেস করলেন “আমার ভাগ্যে কি হিন্দুস্তানের সিংহাসন রয়েছে?”, তখন হুযুর হ্যা সূচক উত্তর দিলেন, এবং পরবর্তীতে সে শাহজাহানই হিন্দুস্তানের সম্রাট হিসেবে সিংহাসনে আরোহন করলেন। শাহজাহান যখন পিতার স্থলাভিষিক্ত হলেন তখন তিনি তাঁর খাস দূতকে দিয়ে চিঠি ও সুবিশাল জাইগীর (জমিনের পরিমাণ) হাদিয়া স্বরূপ হুযুর সুলতানুল আরিফিন এর দরবারে পাঠালেন, বাদশাহী লাভ করার সুসংবাদ দিলেন, দু’আর দরখাস্ত করলেন এবং এরই পাশাপাশি সম্রাট শাহজাহান পুনরায় হুযুর সুলতানুল আরিফিনের দরবারে হাজির হওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করলেন । দূত যখন হযরতের দরবারে হাজির হলো, হযরত তখন হুক্কা খাচ্ছিলেন, দূত সালাম দেয়ার পর হুযুরের নিকট সম্রাটের চিঠি ও জাইগীর এর দলীল পেশ করলো, চিঠি পাঠরত অবস্থাতেই হযরতের চেহারায় রাগ ও ক্রোধের আলামত প্রকাশ পেলো। এবং সাথে সাথে জাইগীরের সনদ্গুলোকে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেললেন এবং কাগজের টুকরোগুলোকে হুক্কার ওপরে থাকা কয়লার মাঝে রেখে দিলেন, যা নিমিষেই পুড়ে ছাই হয়ে গেলো।

এরপর হযরত চিঠির জবাব লিখতে আরম্ভ করলেন, “আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের হাজারো শুকরিয়া ও মেহেরবানী, যিনি এই ফকিরের দু’আ কবুল করেছেন এবং তোমাকে শাহী মসনদ দান করেছেন, সম্মান ও লাঞ্ছনা সবই তাঁর পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। তাঁর ইচ্ছা ব্যতীত কোন কিছুই হয়না। তোমার উচিৎ অধিক হারে খোদা তাআলার শুকরিয়া আদায় করা এবং তাঁর মাখলুকের দেখাশোনায় মনোনিবেশকরা, সমস্ত কাজে ইনসাফ ও ন্যায়পরায়ণতা বজায় রাখা । তুমি, আমি ফকিরের সাথে পুনরায় সাক্ষাৎ করার আশা ব্যাক্ত করেছো, তাই জেনে নাও যে, প্রথমবার যখন তুমি আমার সান্নিধ্যে এসেছিলে তখন তুমি একজন করুনাকামী শাহজাদা রূপে উপস্থিত হয়েছিলে, তাই আমি ফকিরের সহিত তোমার সাক্ষাৎ বৈধ ছিল। আর এখন বাদশাহীর আসনে সমাসীন, অতএব, তোমার সাথে আমার সাক্ষাত করা অবৈধ ।

উলামাগণ আম্বিয়ায়ে কিরাম আলাইহিমুসসালাম এর উত্তরাধিকারী, উলামাগন রাজা বাদশাহদের সহিত মেলামেশা করেননা। এবং তুমি জাইগিরের (জমিনের) দলীল কেনো পাঠালে ? তোমার এবং আমার রিযিকদাতা কি ভিন্ন ? যখন বিষয়টি এমন নয় । রাযযাক, যিনি তোমাকে সিংহাসনের ওপর রিযিক পাঠান তিনিই আমাকে ছেড়া চাটাই এর ওপর রিযিক পাঠান। আর হ্যা, তুমি আমার নিকট দুআয়ে খায়েরের আবেদন করেছো এবং উলামায়ে কিরাম ও সালেহীন বান্দাগণের উচিৎ, তারা যেন ন্যায়পরায়ন বাদশাহের কল্যাণের স্বার্থে দুআ করেন। অতএব, তোমারও কল্যাণে আমার দু’আ থাকবে তবে স্মরণ রেখো, এই দু’আ ততক্ষন পর্যন্ত জারী থাকবে যতক্ষন পর্যন্ত তোমার মাঝে ইনসাফ ও ন্যায়পরায়নতার গুনাগুন বিদ্যমান থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *