নহে এ সম্মান বাহুবলে অর্জিত যদি না দয়া করেন খোদা মেহেরবান
পর্ব-১
উপমহাদেশে ইলমে দ্বীন ও বিশেষতইলমুল হাদীস এর প্রচার প্রসারে যারা অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছেন, তাদের মধ্যে সুলতানুল আরেফিন সায়্যিদ শাহবাজ মুহাম্মাদ ভাগলপুরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এক মহান ও চির অবিস্মরণীয় নাম । হুযুর সুলতানুল আরেফিন ইলমে দ্বীনের পাশাপাশি বেলায়াত গগনের মধ্য দিবসের সূর্য হিসেবে আউলিয়ায়ে কিরামের মাঝে পরিচিত । তথাপি, ইলমে যাহিরী ও ইলমে বাতিনী উভয় অঙ্গনে সুলতানুল আরেফিন এক অমর ব্যক্তিত্য হিসেবে যুগ যুগ যাবৎ স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। নিম্নে, সংক্ষেপেউনার জীবনালোচনা করার প্রয়াস করছি।
জন্ম- হুযুর সুলতানুল আরেফিন ৯৫৬ হিজরী মোতাবেক ১৫৪৯ খ্রিস্টাব্দে সেলিম শাহ সুরীর যুগে ভারতের গয়া নামক জেলার “দেওরা” গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর সম্মানিত পিতার নাম হযরত সায়্যিদ হাজী খাত্তাব রহমাতুল্লাহি আলাইহি এবং মাতার নাম বিবি মাজিদা রহমাতুল্লাহি আলাইহা।দাদাজান হযরত হাজী সায়্যিদ খাইরুদ্দীন হুসাইনি বুখারি রহমাতুল্লাহি আলাইহি বুখারার জারোহা নামক শহরের বাসিন্দা ছিলেন। বনু আব্বাস এর শাষনামলে যখন খান্দানে বনু ফাতিমার ওপর অমানবিক নির্যাতন আরম্ভ হল, তখন তিনি তৎকালীন শাষকদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে হিজরত করার উদ্দেশ্যে ৯২০-৯২৭ হিজরীর মাঝামাঝি সময়ে বুখারা ত্যাগ করে সপরিবারে মক্কা শরীফের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন এবং সেখানে বেশ কিছুদিন অবস্থান করেন, এবং যখন শেষবারের ন্যায় হজ্জ পালন করেন তখন তাঁর সাথে পুত্র সায়্যিদ খাত্তাব ও ছিলেন। অতঃপর, যিয়ারতে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। এবং যখন রওযায়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম এর সামনে উপস্থিত হয়ে সালাম পেশ করেন তখন রওযায়ে আতহার থেকে সালামের জওয়াব শুনতে পান এবং পাশাপাশি এ সুসংবাদও শুনতে পান, যে “তোমার পুত্র সায়্যিদ মুহাম্মাদ খাত্তাব এর ঔরসে একটি নূর আমানত রয়েছে যে আমার শরীয়তের সুরক্ষক, তরিকতের বাদশাহ এবং মিল্লাতে হানিফ এর ইমাম হবে। যখন সে জন্ম গ্রহন করবে তখন তাঁর নাম “শাহবাজ মুহাম্মাদ” রাখবে”, এর কিছুদিন পর মক্কা শরীফে সুলতানুল আরেফিন এর দাদাজান ও দাদীজান এর ইন্তিকাল হয় এবং উভয়কেই সাফা পাহাড়ের নিকট অবস্থিত জাবালে আবু কুবাইস এর পাদদেশে দাফন করা হয়।
শৈশব- বংশীয় রেওয়াজ অনুযায়ী চার বছর চার মাস চার দিন বয়সে হযরত সুলতানুল আরেফিনকে বিসমিল্লাহখানী তথা পড়ালেখার হাতেখড়ির জন্য অত্র এলাকার এক মহান বু্যুর্গের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। এবংএরপর থেকেই তিনি যথারীতি ইলমে দ্বীন হাসিলে নিয়োজিত হয়ে পড়েন। ছোটবেলা থেকেই তিনি অন্য দশটি ছেলে থেকে ছিলেন একেবারেই আলাদা। খেলাধুলার প্রতি তাঁর বিশেষ কোন আগ্রহ ছিলনা, এবং এ সময় থেকেই তাঁর কথাবার্তা ও ওঠাবসায় অন্যান্য শিশুদের তুলনায় বিস্তর পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। ছোটকাল হতেই তিনি ছিলেন সততা , ধৈর্য,আনুগত্য, আদব ও সহিষ্ণুতার প্রতীক । বাল্যকাল হতেই তিনি সর্বদা তাঁর সহপাঠিদের খোজখবর নিতেন।
ছাত্রজীবন- মক্তব শেষ করার পর স্বীয় পিতার নিকট হতেই প্রাথমিক শিক্ষা হাসিল করেন। প্রাথমিক পর্যায়েই তিনি প্রায় ১৭টি বিষয়ের ওপর পারদর্শিতা লাভ করেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল নাহভ, সরফ, মানতিক, ফালসাফা, ইলমে মাআনী, ইলমে বায়ান, ইলমে তাফসীর, উসুলে তাফসীর, ইলমে হাদীস, উসুলে হাদীস, জ্যোতির্বিদ্যা, প্রকৌশল বিদ্যা ইত্যাদি । এ ছাড়াও তৎকালীন সময়ের প্রসিদ্ধ আলিম ও বিচারপতি শাহ মুহাম্মাদ আব্বাস দেওরাভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর নিকট হতে ইলমে ফিকহ সহ অন্যান্য বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেন।
উচ্চশিক্ষা হাসিল- উচ্চশিক্ষা হাসিল করার উদ্দেশ্যে তিনি হিন্দুস্তানের তৎকালীন রাজধানী ও জ্ঞানচর্চার মূলকেন্দ্র জৌনপুরে চলে আসেন এবং সেখানে অত্যন্ত দুরূহ ও কঠিন সময় অতিবাহিত করেন। খেয়ে না খেয়ে দিন যাপন করেন । কথিত রয়েছে, তাঁর মাদরাসায় না থাকার ব্যবস্থা ছিল না রাত জেগে পড়ার। দিনভর নিজ শিক্ষকের সান্নিধ্যে থাকতেন এবং রাতভর এক রুটি ওয়ালার দোকানে এসে পাহাড়াদার হিসেবে থাকতেন, এ শর্তে যে দোকানদার দোকান বন্ধ করার পর দোকানের চেরাগ প্রজ্বলিত থাকবে, যাতে করে সেই চেরাগের আলোতে বসে তিনি পড়ালেখা করতে পারেন। সেখান থেকে পড়ালেখা শেষ করে তিনি কান্নৌজ চলে আসেন এবং সেখানেও বড় বড় উলামায়ে কিরাম হতে ইলমে দ্বীন অর্জন করেন। ইলমপিপাসু সুলতানুল আরিফিন শুধুমাত্র হিন্দুস্তানেই ইলম অর্জন করে ক্ষান্ত হননি এবং তৃপ্তি লাভ করেননি বরং ইলমপিপাসা নিবারণ করার উদ্দেশ্যে ৯৭০ হিজরীতে হিজাযে মুকাদ্দাসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। সফরের যাবতীয় মুসিবত ও অবর্নণীয় ক্লেশউপেক্ষা করে মক্কা শরীফে আগমন করেন এবং সেখানে প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও কা’বা শরীফের শাফিঈ মাজহাবীদের তৎকালীন ইমামশিহাবুদ্দিন আহমাদ ইবনু হাজার আল হাইতামি আল মাক্কি আল শাফিয়ি রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর হাদিসের দারসে একাধারে ৩ বছর অংশগ্রহণ করেন। অতঃপর আল্লামা ইবনু হাজার হুযুর সুলতানুল আরিফিনকে সনদে হাদীস দান করেন।