মসজিদে গিয়ে আরবিতে আযান দেওয়া
মাওলানা শেখ হিশাম কাব্বানির রচনা থেকে মাওলানা শেখ নাজিম আদিল আল হাক্কানি (قدس سرّه)জন্মস্থানে পৌঁছানোর পরে মাওলানা শেখ নাজিম (قدس سرّه) এর প্রথম কাজটি ছিল মসজিদে গিয়ে আরবিতে আযান দেওয়া। ফল হলো, তিনি সঙ্গে সঙ্গে কারাগারে বন্দী হলেন। এক সপ্তাহ কারাগারে ছিলেন। মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিকোশিয়ার বড় মসজিদে যান এবং এর মিনার থেকে আযান দেন। এতে কর্মকর্তারা খুব রেগে গেলেন এবং তারা তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলেন। মামলা মোকদ্দমার অপেক্ষার সময় তিনি নিকোশিয়া এবং আশেপাশের গ্রামগুলিতে গিয়ে মিনার থেকে আযান দিতেন। ফলস্বরূপ, আরও অনেক মামলা হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে ১১৪ টি মামলা বিচারাধীন ছিল। আইনজীবীরা তাকে আযান বন্ধ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি বলেছিলেন, ‘না, আমি পারব না। মানুষের অবশ্যই আযান শুনতে হবে।”. নির্দিষ্ট দিনে ১১২ টি মামলা শুনানির জন্য উপস্থাপিত হয়েছিল। অবস্থা ছিল: যদি মামলায় তিনি দোষী সাব্যস্ত হন, তবে তিনি ১০০ বছরেরও বেশি সময় কারাভোগ করতে পারেন। একই দিনে, তুরস্ক থেকে নির্বাচনের ফলাফল এলো: আদনান মেন্ডেরেস নামে একজন ভোটে জিতে ক্ষমতায় বসলেন। রাষ্ট্রপতি হিসাবে তাঁর প্রথম পদক্ষেপ ছিল সমস্ত মসজিদ খুলে দেওয়া এবং আরবি ভাষায় আযান দেওয়ার অনুমতি দেওয়া। এটি ছিল আমাদের গ্র্যান্ডশেখের একটি অলৌকিক ঘটনা।সে সময় শেখ নাজিম সমগ্র সাইপ্রাস জুড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন, এবং তারিকার শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে লেবানন, মিশর, সৌদি আরব এবং আরও অনেক জায়গায় গিয়েছিলেন। ১৯৫২ সালে তিনি দামেস্কে ফিরে আসেন এবং গ্র্যান্ডশেখের অন্যতম মুরিদ হাজ্জাহ্ আমিনা আদিলের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। সেই সময় থেকে তিনি দামেস্কে থাকতেন এবং প্রতি বছর তিনি রজব, শাবান ও রমজানের তিন মাস সাইপ্রাসে যেতেন। তাঁর পরিবার তাঁর সঙ্গে দামেস্কে থাকত এবং সাইপ্রাসে গেলে তারা সেখানে যেতেন। তাঁর দুজন মেয়ে [হাজ্জাহ নাজিহা ও হাজ্জাহ রুকাইয়া] ও দুজন ছেলে [শেখ মেহমেত ও শেখ বাহাউদ্দিন] ছিল।তাঁর ভ্রমণ-মাওলানা শেখ নাজিম সাইপ্রিয়ট হজযাত্রীদের কাফেলার নেতা হিসাবে প্রতি বছর হজে যেতেন। তিনি মোট ২৭ বার হজযাত্রা করেছিলেন।তিনি গ্র্যান্ডশেখের মুরিদ ও অনুসারীদের দেখাশোনা করতেন। একসময় গ্র্যান্ডশেখ তাকে নকশবন্দি তরিকার শিক্ষা, তাসাউফের জ্ঞান এবং ধর্মীয় জ্ঞান প্রচারের জন্য দামেস্ক থেকে পায়ে হেঁটে আলেপ্পো যাওয়ার এবং পথে পথে প্রতিটি গ্রামে থামার নির্দেশ দিয়েছিলেন। দামেস্ক এবং আলেপ্পোর দূরত্ব প্রায় ৪০০ কিলোমিটার। যেতে এবং ফিরে আসতে এক বছরেরও বেশি সময় লেগেছিল তার। তিনি এক-দু’দিন হাঁটতেন, একটি গ্রামে পৌঁছাতেন, এক সপ্তাহ গ্রামে কাটাতেন, নকশবন্দি তরিকা ছড়িয়ে, যিকর পরিচালনা করে ও সাধারণ লোকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে, তার পরের গ্রামের রাস্তায় নামতেন। খুব দ্রুতই তার নাম জর্দানের সীমানা থেকে আলেপ্পোর কাছাকাছি তুরস্কের সীমান্ত পর্যন্ত প্রত্যেকটি মানুষের মুখে মুখে ফিরল।একইভাবে, গ্র্যান্ডশেখ একবার শেখ নাজিমকে সাইপ্রাসের মধ্য দিয়ে চলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে হেঁটে মানুষকে ইসলামের দিকে আহ্বান জানিয়েছিলেন। নাস্তিকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বস্তুবাদ ত্যাগ করতে এবং আল্লাহর কাছে ফিরে আসার জন্য আহ্বান জানাতেন। তিনি সাইপ্রাস জুড়ে এতটাই সুপরিচিত হয়ে ওঠেন যে তাঁর পাগড়ির রঙ এবং জোব্বা দুটিই গাঢ় সবুজ রঙের হওয়ায় সারা দ্বীপ জুড়েই “সবুজ মাথার শেখ নাজিম” (শেহ নাজিম ইয়েসিলবাস) নামে পরিচিতি পান।সাম্প্রতিক বছরগুলিতে তিনি তুরস্কে একই রকমভাবে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ১৯৭৮ সাল থেকে প্রতি বছর তিন থেকে চার মাস তিনি তুরস্কের একেক অঞ্চল জুড়ে ভ্রমণ করেছেন। এক বছরে তিনি ইস্তাম্বুল, ইয়ালোয়া, বার্সা, এসকিসেহির এবং আঙ্কারা অঞ্চল ভ্রমণ করলেন। পরের বছরে তিনি কোনিয়া, ইস্পার্টা, কিরশেহির ভ্রমণ করলেন। আরেক বছরে তিনি দক্ষিণ সমুদ্র সৈকত, আদানা থেকে মেরসিন, আলানিয়া, ইজমির, আন্তালায় ভ্রমণ করলেন। এরপরে আর এক বছর তিনি ইরাকের সীমান্ত পর্যন্ত পূর্ব দিকের দিয়ারবাাকির, এরজুরুমে গেলেন। তিনি হয়তো আরেকবার কৃষ্ণসাগরে সমুদ্রযাত্রায় কাটালেন; এক জেলা থেকে অন্য জেলাতে গেলেন। তিনি এক শহর থেকে অন্য শহরে গিয়ে এক মসজিদ থেকে অন্য মসজিদে আল্লাহর বাণী ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং যেখানেই যেতেন সেখানে আধ্যাত্মিকতা ও ঐশী আলো ছড়িয়েছিলেন।মাওলানা শেখ নাজিম (কা.) যেখানেই ভ্রমণ করতেন সাধারণ মানুষ ভিড় করে অভিবাদন ও স্বগত জানাত। সরকারি লোকেরাও তাকে স্বাগত জানাতেন। তিনি পুরো তুরস্ক জুড়ে ‘আল-কিব্রিসি’ এই প্রিয় ডাকনামেই পরিচিত। তিনি ছিলেন তুরস্কের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি তুরগুত ওজালের শেখ এবং তিনি তাঁর দ্বারা অত্যন্ত সম্মানিত ছিলেন। মিডিয়া এবং সংবাদমাধ্যমগুলি তাঁকে যে বিস্তৃত কভারেজ দিয়েছে তার জন্য তিনি তুরস্ক জুড়ে সুপরিচিত। তুরস্কের ঘটনাবলী এবং তার ভবিষ্যতের বিষয়ে তার মতামত জানতে প্রায় প্রতি সপ্তাহে কোনও না কোনও টেলিভিশন স্টেশন এবং রিপোর্টাররা তার সাক্ষাৎকার নিচ্ছে [মাওলানার জীবদ্দশার শেষ বছরগুলির কথা বলা হচ্ছে]। তিনি নবি ﷺ এর দেখানো মধ্যপন্থা অবলম্বন করতেন; সেক্যুলারবাদী সরকার ও ইসলামপন্থী গোষ্ঠীর মধ্যকার সূক্ষ্ম রেখা ধরে চলেন। এটি সাধারণ মানুষ এবং বুদ্ধিজীবী উভয়ের হৃদয় এবং মনে আনন্দ এবং শান্তি নিয়ে আসে।১৯৭৪ সাল থেকে মাওলানা শেখ নাজিম (কা.) ইউরোপ ভ্রমণ শুরু করেছিলেন; প্রতি বছর সাইপ্রাস থেকে লন্ডন বিমানে ভ্রমণ করেতেন এবং গাড়িতে করে ফিরে আসতেন। তিনি প্রতিটি দেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ ধর্ম ও সংস্কৃতির সমস্ত ধরণের লোকের সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন। লোকেরা তাঁর কাছ থেকে শাহাদা, তরিকত এবং আধ্যাত্মিক রহস্য গ্রহণ করে জীবন বদলে নিয়েছে।সায়্যিদিনা শাহ নকশবন্দ যেমন বুখারা এবং মধ্য এশিয়ার মুজাদ্দিদ ছিলেন, যেমন সাইয়্যিদিনা আহমদ আস-সিরহিন্দি আল-মুজাদ্দেদী ছিলেন দ্বিতীয় সহস্রাব্দের পুনর্জাগরণকারী (রিভাইভার), যেমন সাইয়্যিদিনা খালিদ আল-বাগদাদী নতুনভাবে বাঁচিয়েছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের ইসলাম, শরিয়াহ ও তরিকত; এখন শেখ মুহাম্মদ নাজিম আদিল আল হাক্কানি হলেন এই যুগে প্রযুক্তি ও বস্তুগত অগ্রগতির এই কালখণ্ডে ইসলামের উদ্ধারক, পুনর্নবীকারক এবং আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী । মানুষকে আধ্যাত্মিকতার প্রথম আসল স্বাদ পাইয়ে দেওয়ার জন্য পুরো ইউরোপ জুড়ে তাঁর এই হাসিখুশি আর জ্বলজ্বলে মুখটি সকলের অত্যন্ত প্রিয়।১৯৯১ সালে তিনি আমেরিকা যাত্রা শুরু করেছিলেন। তার প্রথম ভ্রমণে তিনি ১৫ টিরও বেশি রাজ্য পরিদর্শন করেছেন। তিনি বিভিন্ন বিশ্বাস ও ধর্মের অনেক লোকের সাথে দেখা করেছিলেন: মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি, শিখ, বৌদ্ধ, হিন্দু এবং নিউ এজ বিলিভার্স । এর ফলে উত্তর আমেরিকায় নকশবন্দী তরিকার ১৫ টিরও বেশি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তিনি ১৯৯৩ সালে দ্বিতীয়বার ভ্রমণ করেছিলেন এবং বহু নগর ও শহরে ভ্রমণ করেছিলেন; ঘুরে দেখেছিলেন বহু মসজিদ, গির্জা, সিনাগগ ও মন্দির। তাঁর মাধ্যমে উত্তর আমেরিকার ১০,০০০ এরও বেশি লোক ইসলামে প্রবেশ করেছে এবং নকশবন্দি তরিকায় দীক্ষা নিয়েছে।১৯৮৬ সালে, মাওলানা শেখ নাজিমকে দূরপ্রাচ্যে ভ্রমণ করার জন্য ডাকা হয়েছিল: ব্রুনাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা। তিনি এই দেশগুলির প্রতিটি বড় শহর পরিদর্শন করেছিলেন। সুলতান, রাষ্ট্রপতি, সংসদ সদস্য, সরকারি কর্মকর্তা এবং অবশ্যই সর্বত্র সাধারণ মানুষ তাকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাকে ব্রুনাইয়ের যুগের সাধক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। জনগণের উদারতা এবং বিশেষত সুলতান, হাজি হাসানাল বলকিয়াহ তাকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি মালয়েশিয়ায় নকশবন্দি তরিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শেখ হিসাবে বিবেচিত হন। পাকিস্তানে তিনি তরিকতের উদ্ধারক হিসাবে স্বীকৃত এবং তাঁর হাজার হাজার মুরিদ রয়েছে। শ্রীলঙ্কায়, কর্মকর্তা এবং সাধারণ লোকদের মধ্যে থেকে প্রায় ২০,০০০ এর বেশি মানুষ তার মুরিদ হয়েছেন। তিনি সিঙ্গাপুরের মুসলমানদের মধ্যে বেশ সম্মানিত এবং সেখানে অনেক মুরিদ রয়েছে।তিনি বহুবার লেবানন সফর করেছিলেন, যেখানে আমরা [মাওলানা শেখ হিশাম কাব্বানি ও তার পরিবার] তাঁকে জেনেছিলাম। একদিন আমি আমার চাচার অফিসে ছিলাম। তিনি লেবাননের উচ্চ পদস্থ সরকারী পদে ধর্ম বিষয়ক সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। আসরের সময় ছিলএবং আমার চাচা শেখ মুখতার আলায়লি বৈরুতের আল-উমারি আল কবির মসজিদে নামাজ পড়তেন। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) এর সময়ে মসজিদটি একটি গির্জা ছিল এবং তাঁর সময়েই তা মসজিদে রূপান্তরিত হয়েছিল। মসজিদের নীচে এখনও গির্জার ভিত্তি রয়েছে। আমার চাচা নামাজে ইমামতি করছিলেন; আমার দুই ভাই এবং আমি তাঁর পিছনে নামাজে পড়ছিলাম। একজন শেখ এসে আমাদের পাশে নামাজ আদায় করলেন। তিনি আমার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে তাঁকে বললেন, ‘তুমি কি অমুক না?’ তার নাম বললেন। তিনি আমার অন্য ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে তার নাম ধরে ডাকলেন। তিনি আমার দিকে তাকিয়েছিলেন এবং আমার নাম ধরেও ডেকেছিলেন। আমরা এটি দেখে খুব অবাক হলাম, কারণ আমরা তাকে আগে কখনও দেখি নি। আমার চাচাও তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হলেন।আমার বড় ভাই আমাদের বাড়িতে শেখ নাজিমকে অতিথি করার জন্য জোরাজুরি করলেন আর আমার চাচা আমাদের সাথে এসেছিলেন। আমাদের অতিথি [শেখ নাজিম (কা.)] বলেছিলেন, “শেখ আবদুল্লাহ আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, ‘তোমার ডানদিকে আসরের নামাজের পরে একজনের নাম অমুক, অন্যজনের নাম অমুক এবং আরেকজনের নাম অমুক থাকবে। তাদের নকশবন্দি তরিকায় বায়াত কর। তারা আমাদের অনুগামীদের মধ্যে হতে যাচ্ছে।’ তিনি সবার নাম ধরে ডেকে আমাদেরকে অবাক করে দিয়েছিলেন এবং তাঁর প্রতি আমাদের আকৃষ্ট করেছিলেন। আমি বিশেষত তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম অনেক কম বয়সেই ।সেই থেকে তিনি নিয়মিত বৈরুত ভ্রমণ করাকে অভ্যেসে পরিণত করেছিলেন। আমরা গ্র্যান্ডশেখ আবদুল্লাহ এবং শেখ নাজিমকে দেখতে প্রতি সপ্তাহে দামেস্কে যেতাম। আমরা প্রচুর আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন করেছি এবং দেখেছি যে তারা আধ্যাত্মিক শক্তি মুরিদদের হৃদয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। আমরা তাদের প্রতি এতটাই আকৃষ্ট হয়েছিলাম যে আমরা আমাদের বাবাকে সবসময়ই অনুরোধ করতাম যেন তিনি প্রতি রবিবার তাদের কাছে নিয়ে যান।মাওলানা শেখ নাজিমের বাড়ি কখনওই দর্শনার্থী ছাড়া ছিল না। প্রতিদিন অন্তত একশত দর্শনার্থী তাঁর বাড়িতে যেত। তিনি তাদের প্রত্যেকের খেদমত করতেন। দামেস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে গ্র্যান্ডশেখের বাড়ির কাছে জাবাল কাসিয়ুন পাহাড়ে তাঁর বাড়ি ছিল। তিনি একটি ছোট স্টুকো বাড়িতে থাকতেন। সেখানে সবকিছু হাতে-তৈরি ছিল, হয় কাঠের বা অন্য কোনও সহজ প্রাকৃতিক উপকরণের।