হযরত মাওলানা সাইয়্যিদ শাহবাজ মুহাম্মদ ভাগলপুরী (রহঃ)
পর্ব-৪
হুযুর সুলতানুল আরিফিন এবং সুন্নাতের অনুসরণ- হুযুর সুলতানুল আরিফিন এর দৈনন্দিন জীবন এর প্রতিটি মুহূর্ত কুরআনে মাজীদ এর আয়াত “যে ব্যক্তি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম এর আনুগত্য করলো, নিঃসন্দেহে সে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর আনুগত্য করলো” এর জলজ্যান্ত উদাহরন ছিল, তাঁর যিন্দেগীর প্রতিটি শ্বাস প্রশ্বাস সুন্নাতের আনুগত্য, ইশকে ইলাহী, ইশকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর রঙে রঙিন ছিল । তিনি “ওয়াহদাতুল উজুদ” এ বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি নিজের যিন্দেগী অর্থাৎ জীবনযাপন এবং বন্দেগী তথা ইবাদতে মহান আল্লাহ তাআলার রেযামন্দি ব্যতীত আর কোন কিছুর তোয়াক্কা করেননি। তাঁর চালচলন, ওঠা বসা, খাওয়া দাওয়া প্রতিটি কাজই সুন্নাতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম এর জীবন্ত নিদর্শন ছিল, নিম্নে তার কয়েকটি নমুনা তুলে ধরা হল।
পোশাক- হুযুর সুলতানুল আরিফিন পিরাহান (কুর্তা), তাহবন্দ (লুঙ্গী), ও পাঁচকোনা বিশিষ্ট টুপি পরিধান করতেন। পাঠদান ও ইমামতি করা কালীন সময়ে জুব্বা বা আবা পরিধান করতেন।যৌবনে যেরূপ এক ভাজবিশিষ্ট সুতি কুর্তা পরিধান করতেন তদ্রূপ বৃদ্ধ বয়সেও এক ভাজবিশিষ্ট সুতি কুর্তা পরিধান করতেন, ইশকে ইলাহি ও ইশকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম এর তাজাল্লী সর্বদা তাঁর দেহকে আবৃত করে রাখতো এমনকি প্রচন্ডশীতের মৌসুমেও তাঁর হাত মোবারকে হাত পাখা থাকতো, যার দ্বারা তিনি নিজেকে বাতাস করতেন।
বিছানা- চারপায়া বিশিষ্ট তোষকবিহীন খাটের ওপর ঘুমাতেন যা মূলত দড়ি দ্বারা বুনন করা ছিল। অধিকাংশ সময় তার মলীন শরীরে দড়ির দাগ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠতো, এছাড়াও অধিকাংশ সময় তিনি সরাসরি জমিনের ওপর শুয়ে আরাম করতেন। তাকে যখনই নরম তোষক বা গদি ব্যবহার করার জন্য অনুরোধ করা হতো, তখন তিনি বলতেন, “কে জানে ? নবীয়েপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম কি কখনোও এতো নরম তোষক বা গদি ব্যবহার করেছেন কিনা, যদি তিনি এরূপ না করে থাকেন তবে এটা বিদ’আত হবে।”। তিনি যখন শয়ন করতেন তখন নিজ দেহকে এমনভাবে গুটিয়ে রাখতেন যেন উপর থেকে দেখে মনে হতো আরবী ভাষায় “মুহাম্মাদ” লেখা আছে।
খাদ্যাভ্যাস- হুযুর সুলতানুল আরিফিন অত্যন্ত কম খাদ্য গ্রহনে অভ্যস্ত ছিলেন । কখনও পেট পুরে খাবার খাননি, অধিকাংশ সময় রোজা রাখতেন যৌবনের আরম্ভ থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত সপ্তাহে শুধু একদিন রোযা ত্যাগ করতেন, বাকি ছয় দিন রোযার হালতে থাকতেন, এবং প্রায় চল্লিশ বছর যাবৎ এ আমল করেছেন। শেষ বয়সে পরিবারবর্গ ও শিষ্যগনের পিড়াপীড়িতে সপ্তাহে দুই দিন খাবার গ্রহন করতেন বাকি পাঁচ দিনরোযা রাখতেন। তাঁর খাবারের তালিকায় চিকন চালের ভাত, আটার রুটি, মোরগের গোশত, ঘি এবং দই থাকতো এবং এ পাঁচটি খাবারের সমন্বয়কে “মাকতাই” বলা হতো। হুযুর এ পাঁচটি খাদ্য অত্যন্ত পছন্দ করতেন ।
হুযুর সুলতানুল আরিফিনের কারামাত- হুযুর সুলতানুল আরিফিনের দরবার সমস্ত মাখলুকের আশ্রয়স্থল ছিলো। যেখানে সব ধরনের, সব জাতের, সব রঙের, সব বর্ণের মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকতো। এমনকি সেখানে অন্যান্য ধর্মগুরুদের ও বিচরন দেখা যেত । একদিন হযরতের দরবারে এক হিন্দু যোগী আসলো এবং হুযুরকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো “ফানা কি এবং বাকা কি?” এর বাস্তব উদাহরণ আপনি আমাদের সম্মুক্ষে পেশ করুন। যোগীর মুখে এ কথা শুনে হযরত ইরশাদ করলেন, ‘চলে যাও, দূর হয়ে যাও, এটা রঙ তামাশার স্থান নয়, এবং ফানা ও বাকা কোন খেলার বস্তু নয়, যখন যেখানে ইচ্ছা শুরু করে দিলাম”।
উত্তরে যোগী বললো, “আপনাদের সূফীদের নিকট তো ফানা ও বাকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, অথচ আপনি তা দেখাতে টালবাহানা করছেন। তবে যেনে রাখুন, আমিও ফানা ও বাকা হাসিল করেছি, তবে তা ৩৬ বছরের সাধনার ফলে”, তখন হযরত ইরশাদ করলেন, “তাহলে দেরী কেনো ? এক্ষুনি দেখাও”। যোগীএ কথা শুনে সামনে থাকা শুকনো হাউজে নেমে পড়লেন এবং চোখ বন্ধ করে কিছু একটা জপতে লাগলো, ঘন্টাখানেক পর দেখা গেলো যে তাঁর অস্তিত্ব ধীরে ধীরে বিলিন হয়ে যাচ্ছে এবং একসময়ে তা পানিতে পরিণত হয়ে গেলো। এ অবস্থা দেখে হযরত তাঁর এক খাদিমকে সেখান থেকে এক শিশি পানি ভরে রেখে দিতে বললেন, এর কিছুক্ষণ পর যোগী আবার তাঁর পূর্বাবস্থায় ফিরে এলো এবং হাত ঝাড়তে ঝাড়তে হাউজ থেকে বেড়িয়ে এলো এবং বললো, “দেখলেন আমার ক্ষমতা?” হযরত মুচকি হেসে বললেন “দেখেছি”, এরপর হযরত খাদিমগণকে ভালোভাবে হাউজটি ধুয়ে ফেলার নির্দেশ দিলেন এবং তিনি স্বয়ং হাউজটিতে নেমে পড়লেন, কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন এবং এর পর “লাইলাহা ইল্লাল্লাহ” এর একটি আওয়াজ আসলো এবং দেখতে দেখতেই হযরতের দেহ পানিতে বিলীন হয়ে গেলো এবং পানির প্রতিটি বিন্দু থেকেই “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” এর ধ্বনি আসছিলো । এমনাবস্থায় খাদিম একটি শিশিতে কিছু পানি রেখে দিলো, কিছুক্ষণ পর আবার ঐ পানির বিন্দুসমূহ থেকে “মুহামমাদুর রাসুলুল্লাহ” সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম এর আওয়াজ আসলো এবং সাথে সাথে হযরতের দেহ পূর্বাবস্থায় ফিরে এলো।
অতঃপর, হুযুর সুলতানুল আরিফিন পরে যখন খানকাহে তাশরীফ আনলেন তখন আবার যোগী তাঁর সামনে এসে উপস্থিত হলো এবং বললো “আপনার আমল আমার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল, আপনি খুব দ্রুত গেলেন এবং অতি দ্রুতই ফিরে এলেন আর আমি খুব দেরীতে গেলাম এবং দেরীতে ফিরে আসলাম, তবে আমাদের উভয়ের আমল কিন্তু একই।” প্রত্যুত্তরে হযরত ইরশাদ করলেন, কক্ষনো না।এ বলে হযরত খাদিম কে ডেকে যোগীর পানির শিশি এনে যোগীর হাতে তুলে দিতে বললেন, এবং যোগীকে শিশির ঢাকনা খুলতে বললেন, যোগি যেমনি শিশির ঢাকনা খুললো সাথে সাথে অসহ্যকর দুর্গন্ধ বের হতে লাগলো এবং উপস্থিত লোকদের বমি আসতে লাগলো, দুর্গন্ধ এতটাই বিকট ছিল যে খোদ যোগীও তা সহ্য করতে না পেরে দূরে গিয়ে শিশিটি নিক্ষেপ করে আসলো। এরপর হযরত খাদিমকে নিজের শিশি আনতে বললেন, এবং শিশি খোলা হল, শিশির মুখ খোলার সাথে সাথেই পুরো মাহফিল সুগন্ধিতে ভরপূর হয়ে গেলো, উপস্থিত শ্রোতাবৃন্দ আনন্দিত ও উজ্জীবিত হলেন এ দৃশ্য দেখে হিন্দু যোগী জিজ্ঞেস করলো “এমন কেন হলো” ? হুযুর সুলতানুল আরিফিন সংক্ষিপ্তভাবে জবাব দিলেন “ঐটা কুফর ছিল এবং এটা ঈমান”।
তখন যোগী বললো, “এতো বছর সাধনা ও তপস্যা করার পরও কেন আমার অন্তরের তালা খুললোনা” ? উত্তরে হুযুর সুলতানুল আরিফিন বললেন, “তোমার নিকট যে তালা খোলার চাবি নেই” যোগী জিজ্ঞেস করলো,সেটি আবার কোন চাবি ? হুযুর সুলতানুল আরিফিন ইরশাদ করলেন “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ” সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম পাঠ করে নাও, তবেই অন্তরের বন্ধ তালা খুলে যাবে এবং নিজের অস্তিত্বের খুশবুও পেয়ে যাবে, এ কথা শোনা মাত্র যোগী হুযুর সুলতানুল আরিফিন এর কোমল চরণে লুটিয়ে পড়লো এবং ইসলামে দাখিল হয়ে গেলো।