আজ ভয়াল ১২ নভেম্বর, উপকূলবাসীর বেদনা বিধুর ইতিহাসের দিন

Spread the love

আহসান হাবীব:  আজ শুক্রবার সেই ভয়াল ১২ নভেম্বর। ৫১ বছর আগের সেই দিনের বেদনা বিধুর ইতিহাস বাঙালী জাতি আজও ভুলতে পারেনি। ১৯৭০ সালের এই দিনে সমগ্র উপকূল জুড়ে বয়ে যায় মহা প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে ১৯৭০ সালের ভয়ঙ্কর সেই ঘূর্ণিঝড়েই সবচেয়ে বেশি মানুষ প্রাণ হারান। ধারণা করা হয়, ১২ নভেম্বরের সেই দুর্যোগে প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় ১০ লাখ মানুষ। তার মধ্যে শুধু ভোলা জেলাতেই লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। অবস্থা স্বাভাবিক হলে সেই সময়কার মেঘনা নদী আর তার শাখা-প্রশাখাগুলো যেন হয়ে উঠে লাশের নদী। সেই ভয়াবহ দৃশ্য আজও ভোলেনি বাংলাদেশ। জানা গেছে, ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর ছিল বৃহস্পতিবার। কিন্তু ১১ নভেম্বর বুধবার সকাল থেকেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিলো উপকূলীয় এলাকাগুলোতে। ১২ নভেম্বর পরিস্থিতি হঠাৎ করেই ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। ওই দিন দিবাগত রাতেই ফুঁসে উঠে সমুদ্র। ‘পাহাড়সম’ উঁচু ঢেউ তীব্র বেগে ধেয়ে আসে লোকালয়ের দিকে। প্রায় ৩০/৪০ ফুট উঁচু সেই ঢেউয়ের আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় লোকালয়। মুহূর্তেই ভেসে যায় মানুষ, গবাদিপশু, ঘরবাড়ি, ক্ষেতের ফসল। সমুদ্র শান্ত হলে পথে-প্রান্তরে যেখানে-সেখানে পড়ে থাকতে দেখা যায় শুধু লাশ আর লাশ। চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ সেই ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেয়া হয়েছিল গোর্কি। সেদিন কিছু বুঝে উঠার আগেই আঘাত হানে প্রলয়ঙ্কারী এই ঘূর্ণিঝড়। মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয় উকূলীয় জনপদ। কাফন ছাড়াই দাফন হয় লাখো মানুষের। কোথাও কোথাও একই গর্তে ফেলা হয় মানুষ আর গবাদি-পশুর লাশ। বিরান হয়ে যায় মাঠের পর মাঠ, গ্রামের পর গ্রাম। সেই দুঃসহ ১২ নভেম্বর আজ। জাতীয় জীবনের এক চরম বিভীষিকাময় দিন। ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত বুঝতে না পারার খেসারত দিতে হয়েছে উপকুলের ১০ লক্ষাধিক নিরক্ষর মানুষের প্রাণ বিসর্জনের মধ্য দিয়ে। ভেসে যায় গবাদি পশু, হাঁস-মুরগী আর ক্ষতিগ্রস্ত হয় মাঠ ফসল এবং অসংখ্য গাছপালা, পশু-পাখি। পুরো উপকূল মুহূর্তেই ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়। লাসের গন্ধ আর স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে এলাকার আকাশ বাতাস। ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের উপর দিয়ে বয়ে যায় এই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস গোর্কী। ১২ নভেম্বরের মহাপ্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভোলা জেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা মনপুরা। সাগর মোহনার ২৫-৩০ ফুট উঁচু ঢেউ ও জলোচ্ছ্বাসে মনপুরার ৩০ সহস্রাধিক মানুষ ও গবাদি পশু স্রোতের টানে ভেসে গেছে উত্তাল সাগরে। গাছে গাছে ঝুলে ছিল লাশ আর লাশ। প্রকৃতির সাথেই লড়াই করেই বেঁচে আছেন উপকূলসহ দক্ষিণাঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষ। তবে একের পর এক প্রকৃতির তান্ডব অব্যাহত থাকলেও উপকূলবাসীর নিরাপদ আশ্রয় ও প্রাণিসম্পদ রক্ষার বিষয়টি পরিপূর্ণ নিশ্চিত হয়নি। যদিও আগাম সতর্কতার কারণে প্রাণহাণির সংখ্যা আশাতীতভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। পাশাপাশি প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে অন্তত ৫ লাখ মানুষের নিরাপদ আশ্রয়স্থল নিশ্চিত হয়েছে। তবে প্রাণিসম্পদের কোন আশ্রয়স্থল নির্মিত হয়নি। সেই বিভিষিকাময় রাত আজো উপকূলের বয়োজ্যেষ্ঠদের তাড়া করছে। স্বজনহারা সব বয়সী মানুষ দুঃসহ যাতনা নিয়েই স্মরণ করছেন ভয়াল ১২ নভেম্বরকে। সত্তরের ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধ্বংসযজ্ঞ ও বেদনাহতদের দেখতে যান, এসব দৃশ্য দেখে তিনি শোকবিহ্বল হয়ে পড়েন। ১২ নভেম্বরে স্বজনদের মৃত্যুকে স্মরণ করে বিভিন্ন সংগঠন দোয়া, মিলাদ ও বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করে থাকে। শোকের এই দিনটিকে উপকূল দিবস হিসেবে পালন করার জন্য দাবী জানিয়ে আসছেন উপকূলবাসী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *