ইসলামের ইতিহাসে কর্জে হাসানা
ইসলামের প্রাথমিক যুগে সুদমুক্ত অর্থনীতি বাস্তবায়নের জন্যে কর্জে হাসানা ছিল অন্যতম কার্যকর হাতিয়ার। এ সময়ে বায়তুল মালের আয়ের উৎসসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো কর্জ বা ঋণ। প্রকৃতপক্ষে রাসূলে কারীম (সা.)-এর মাদানী জীবন হতে শুরু করে আব্বাসীয় খিলাফতের পরেও সুদীর্ঘ তিনশত বছরেরও বেশি কর্জে হাসানা ইসলামী সমাজে যথাযথ চালু ছিল বলেই সুদ ইসলামী অর্থনীতির ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারেনি। মক্কা বিজয়ের পর জরুরী রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে রাসূল (সা.) কর্জ গ্রহণ করেন। হাওয়াজিন যুদ্ধের পূর্বে রাসূল (সা.) আব্দুল্লাহ বিন রবিয়া থেকে ৩০ হাজার দিরহাম কর্জ গ্রহণ করেন। ইমাম বুখারীর মতে, ২০ হাজার দিরহাম কর্জ গ্রহণ করা হয়েছিল। হুনায়নের যুদ্ধের সময় রাসূল (সা.) সাফওয়ান নামক এক অবিশ্বাসীর নিকট থেকে ৫০টি বর্ম ধার করেছিলেন। কর্জ মুসলিম ও অমুসলিম উভয় উৎস হতে করা হয়েছে বলে বিভিন্ন সুত্রে জানা যায়। হযরত উমর ফারুক (রা.)’র সময়েই বায়তুল মাল হতে কর্জে হাসানা দেবার রীতি ব্যাপকভাবে চালু হয়। ব্যক্তিগত প্রয়োজন ছাড়াও ব্যবসায়িক বিনিয়োগ ও কৃষি কাজে ব্যবহারের জন্যেও বায়তুল মাল হতে কর্জে হাসানা নেবার ব্যবস্থা ছিল। এক্ষেত্রে স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে কোন পার্থক্য বা পক্ষপাতিত্ব হতো না। জনসাধারণ ছাড়াও সরকারী কর্মচারীরাও নিজেদের চাকুরির জামানতে বায়তুল মাল হতে ঋণ নিতে পারত। এছাড়া ব্যক্তিগত পর্যায়ে কর্জে হাসানা ছিল মামুলি ব্যাপার। দরিদ্রদের সাহায্য করার জন্যে মন-মানসিকতার দিক থেকে সম্পদশালী ব্যক্তিগণ সব সময়ই প্রস্তুস্ত ছিলেন। কর্জে হাসানা লেনদেনের পদ্ধতি : ইসলামের মানুষ তার ইচ্ছানুযায়ী যা কিছু করতে পারে না। তাকে কুরআন ও হাদীস নির্দেশিত পথে তার যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। তেমনি কর্জে হাসানা এমন একটি চুক্তি যা নিম্নোক্ত নীতিসমূহকে অনুসরণ করে সমাপ্ত করতে হয়। সেগুলো হলো- ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতা উভয়ের শরীয়াহ মোতাবেক চুক্তি সম্পাদনের যোগ্যতা থাকা :
আইনের চারটি প্রসিদ্ধ শাখা (হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী ও হাম্বলী) এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত যে, ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতা উভয়কে বালিগ, আকিল ও সুবিবেচক হতে হবে। ইয়াতিমদের ধন-সম্পদ তাদের হাতে সোপর্দ করার ক্ষেত্রেও একই নীতি বিদ্যমান। আল কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা ইরশাদ করেন, আর এতিমদের পরীক্ষা করতে থাকো, যতদিন না তারা বিবাহযোগ্য বয়সে পৌছে যায়। তারপর যদি তোমরা তাদের মধ্যে যোগ্যতার সন্ধান পাও তাহলে তাদের সম্পদ তাদের হাতে সোপর্দ করে দাও। (সূরা আন নিসা : আয়াতটি থেকে সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, বিবাহযোগ্য হওয়া ও অর্থ-সম্পদ সঠিকভাবে ব্যবহার করার যোগ্যতা অর্জন হলো পরিপক্বতার মাপকাঠি। এ ধরনের ব্যক্তিরাই কর্জে হাসানার চুক্তি সম্পাদন করতে পারে।একটি হাদীসে রাসূল (সা.) বলেছেন, তিন ধরনের লোকদের ব্যাপারে কিছু লেখা হয় না অর্থাৎ তাদেরকে তাদের কর্ম সম্পর্কে দায়ী করা হয় না। তারা হলো, পাগল যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে; ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত না সে জাগ্রত হয়; এবং সেই যুবক যার মধ্যে পরিপক্বতার অভাব দেখা যায়। (আহমদ আবু দাউদ ও তিরমিযী)। হাদীসটির আলোকে বলা যায়, নাবালক ও অযোগ্য লোক কর্জে হাসানা লেনদেনে লিপ্ত হতে পারে না।
ঋণের প্রস্তাব (ইজাব) ও সম্মতি (কবুল) ঋণচুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পূর্বেই পরিষ্কার করা : আইনের চারটি প্রসিদ্ধ শাখাই এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন যে, ঋণচুক্তিটি কেমন হবে তা ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতা উভয়ের নিকট পরিষ্কার থাকবে। ঋণচুক্তিটি পরিষ্কারভাবে উপস্থাপিত না হলে পরবতীতে দু’পক্ষের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি, এমনকি বিরোধ দেখা দেয়া অস্বাভাবিক নয়। এ জন্য দু’পক্ষের মধ্যে ইজাব ও কবুল অত্যন্ত জরুরি। চুক্তির মেয়াদ স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা : মুসলিম ফকীহদের মধ্যে এ ব্যাপারে সবাই সম্মত যে, ঋণচুক্তির ক্ষেত্রে ঋণ পরিশোধের পদ্ধতি ও তারিখ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা উচিত। এটি করা না হলে ভবিষ্যতে ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার মধ্যে আদান প্রদানে অনিশ্চয়তা ও বিরোধ দেখা দিতে পারে। রাসূল (সা.)-এর সাহাবীদের দৃষ্টান্ত এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। সম্মানিত সাহাবীগণ ঋণচুক্তির ক্ষেত্রে যে পন্থা অবলম্বন করেছিলেন, সেটাই হলো সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য পন্থা। রাসূল (সা.) যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করলেন, তাঁকে জানানো হলো অগ্রিম ক্রয় (সালাম) চুক্তি হয়েছে যেখানে সময় ও পরিমাণ সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। তখন রাসূল (সা.) বললেন, এই চুক্তিতে যারা অংশ নিবে তাদের উচিত সময় ও পরিমাণ সঠিকভাবে উল্লেখ করা। ঋণচুক্তিটি লিখিত হওয়া : ঋণচুক্তিটি লিখিত হতে হবে এটি কুরআন কর্তৃক স্বীকৃত। আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে ঈমানদারগণ! যখন কোন নির্ধারিত সময়ের জন্য তোমরা পরস্পরের মধ্যে ঋণের লেনদেন করো তখন লিখে রাখো। (সূরা আল বাকারাহ : ২৮২) মুসলিম ফকীহদের মধ্যে এ বিষয়ে মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। অধিকাংশ ফকীহর মতে, এটি বাধ্যতামূলক নয়, তবে লিখে রাখার উপর জোর দেয়া হয়েছে। তারা যুক্তি দেখান যে, যদি দু’পক্ষই না লিখিতে সম্মত হয় তবে তারা লিখা হতে অব্যাহতি পেতে পারেন। লিখার পক্ষে যুক্তি হলো ভবিষ্যতের যে কোন প্রকারের বিরোধ এড়ানো। অপরদিকে আল-তাবারির মতে, কিছুসংখ্যক ফকীহ মত দেন যে, চুক্তি লিখিত হওয়া বাধ্যতামূলক। দুটি মতামতের মধ্যে প্রথমটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য। কেননা, দু’পক্ষেরই লিখা বা না লিখার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ থাকা উচিত। দুজন সাক্ষী থাকা : আল্লাহর বাণী হচ্ছে এই যে, ঋণ ও ব্যবসায় সংক্রান্ত লেনদেনের চুক্তি সাক্ষ্য প্রমাণাদিসহ লিখিত আকারে সম্পাদিত হওয়া উচিত। এর ফলে লোকজনের মধ্যে লেনদেন পরিষ্কার থাকবে। আল কুরআনে আল্লাহ বলেন, তারপর নিজেদের পুরুষদের মধ্য থেকে দুই ব্যক্তিকে তার (লিখিত চুক্তিটির) সাক্ষী রাখো। (সূরা আল বাকারাহ : ২৮২) হাদীসে এসেছে, ‘আল্লাহ রাসূল (সা.) বলেছেন, তিন ধরনের লোক আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে কিন্তু তাদের ফরিয়াদ শোনা হয় না। এক. যার স্ত্রী অসচ্চরিত্র কিন্তু সে তাকে তালাক দেয় না। দুই. এতিমের বালেগ হবার আগে যে ব্যক্তি তার সম্পদ তার হাতে সোপর্দ করে দেয়। তিন. যে ব্যক্তি কাউকে নিজের অর্থ ঋণ দেয় এবং তাতে কাউকে সাক্ষী রাখে না।
ফকীহগণ বলেন, যদি পুরুষ সাক্ষী না পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে তবে একজন পুরুষ ও দুজন মহিলাকে সাক্ষী রাখতে হবে। ভবিষ্যতের যে কোন বিরোধ মোকাবিলায় এ এক অনন্য ঐশী সমাধান হাতে কোন সন্দেহ নেই।
প্রশাসনিক ফি ও সার্ভিস চার্জ : এটা খুবই স্বাভাবিক যে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কর্জে হাসানার প্রয়োগ করতে গেলে সেখানে প্রশাসনিক খাতে ও সেবাটি প্রদানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আর্থিক ব্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, এই ব্যয় নির্বাহের জন্য কোন প্রকার ফি ও চার্জ ঋণগ্রহীতার নিকট থেকে গ্রহণ করা অনুমোদিত কিনা এবং যদি অনুমোদিত হয়, তবে তার পরিমাণ কত হবে। ফকীহ্গণ এ ব্যাপারে পরিষ্কার করেছেন যে, প্রশাসনিক ফি ও সার্ভিস চার্জ নেয়া ইসলামী শরীয়াহ’র পরিপন্থী নয়।——————লেখক: এম.এ. ঈসা মাহমুদ হাসেমী।