এশিয়ার অন্যন্য সুন্দর প্রবাল ঘেরা মালদ্বীপ

Spread the love


সৈয়দ আখতার সিরাজী ঃমালদ্বীপ ভারত মহাসাগরের একটি গ্রীষ্ম প্রধান দেশ। ভারতের দক্ষিণ দিক জুড়ে এ দ্বীপের অবস্থান। এর চারিদিকে রয়েছে ২৬টি রিং সেপ কোরাল বা প্রবাল প্রাচীর,
এ সকল অগভীর হ্রদ বা উপহ্রদ একে এক অন্য রকম বৈশিষ্টে সৌন্দর্যময় করেছে যা অতি অপরূপ এবং টুরিস্টদের মন কেড়ে নেয়ার একটি অন্যতম উপাদান। সাদা চিকচিকে বালির উপরে স্বচ্ছ ফটিক জলরাশি, সাথে দূর থেকে ভেসে আসা সমুদ্র গর্জন এ অন্যন্য দেশকে অনেকের থেকে আলাদা করে রেখেছে।
১১৯০টি ছোট কোরাল দ্বীপের সমন্বয়ে এর আয়তন নব্বই হাজার স্কোয়ার কিলোমিটার। মোট জনসংখ্যা মাত্র ছয় লাখের মত তার মধ্য প্রায় তিন লাখের বসবাস এর রাজধানি মালেতে। জনসংখ্যা বা আয়তন কোন দিক থেকেই বাংলাদেশের সাথে এর তুলনা চলেনা। দেশটি বিশেষ ভাবে পরিচিত এর অতি স্নিগ্ধ বিচ, বøু লেগুন্স, বিশাল রিফ এর জন্য। রাজধানি মালেতে রয়েছে বিশাল মাছের বাজার, রেস্তরা, নিরিবিলি রাস্তা ঘাট, কিছু নতুন অবকাঠামো যেমন ব্রিজ যা এক আইল্যান্ড আর একটির সাথে যুক্ত করতে পারে। মালেতে বিশেষ ভাবে বিখ্যাত ১৭তম সেঞ্চুরির বিখ্যাত মসজিদ হুকুরু মিস্কি কারভড কোরাল দ্বারা নির্মিত যা ফ্রাইডে মসজিদ নামেও পরিচিত। মসজিদটি পুরোন হয়ে যাওয়ায় এর ভেতরে বর্তমানে প্রবেশ নিষেধ। দরজার সামনে সতর্ক বাণী রয়েছে এ ব্যপারে। ছোট হলেও মসজিদটি বেশ সুন্দর এবং বেশ পরিছন্ন।
ওদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে যা ডিভেহি নামে পরিচিত যার আদি হচ্ছে সংস্কৃত ও ইন্দো-এশিয়ান ভাষা গ্রæপ এর মধ্যে তবে ভাষা ও উচ্চারণ পার্থক্য এমনকি ডায়ালেক্টও ভিন্ন বিভিন্ন আইলেন্ডে। কিন্তু ইংরেজিতে তারা বেশ সক্ষম কারণ তাদের শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি, ড্রাইভার থেকে শুরু করে, যে কেউ ইংরেজিতে কথা বলতে সাছন্দ বোধ করে যে কারণেই হয়তো ওরা বিপুল পরিমাণে বিদেশী টুরিস্টও আকর্ষণ করতে পেরেছে। মালের বাইরে বা খুব কাছেই হুলহুমালে, এখ্নাকার রাস্তাগুলো বিচের পাড় ঘেঁষে বরাবর। বিচের পাড়ে চেয়ার পাতা রয়েছে তবে রেস্তরাঁগুলো বিচের পাড় ব্যবহার করতে পারেনা, আইন দারা নিষিদ্ধ। স্থানীয় লোকজন জানালো আগে এ ধরনের নিষেধ ছিলনা। বিচের পাড় যাতে পরিস্কার, হল্লামুক্ত, নিরিবিলি থাকে তার জন্য এ ব্যবস্থা। মাঝে মাঝে বসার ব্যবস্থা, দোলনা, গাছ গাছালি পরিবেশকে স্নিদ্ধ করেছে।
রাস্তার পাশে মোবাইল লাইব্রেরি দেখার মতো। পাশে কাঠের পোস্টে বই নেয়া এবং দেয়ার নিয়মাবলি লেখা রয়েছে, কেউ ইচ্ছা করলে বিচে শুয়ে বই পড়ে সময় কাটাতে পারেন। বই ডোনেট করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। কাগজ কলম, নির্দেশনা সব রয়েছে শুধু মানুষ নেই, দক্ষিণ এশিয়ার সমুদ্র পারের এ ছোট্ট দেশে, এ রকম ব্যবস্থা বেশ ভাল লাগলো। এর পরে আরো মজার ব্যপার প্রবাল প্রাচীরের ভেতরে শান্ত সমুদ্রের ভেতরে সুইমিং পুল রয়েছে, বেশ বড় এবং নিরাপদ। অনেকে বাচ্চাদের সাতার শেখাতে এগুলো ব্যবহার করছেন।
মালদ্বীপের জিডিপি মাত্র ডলার ৪.৬০ বিলিয়ন (২০১৭) তবে মাথাপিছু আয় প্রায় ডলার ১০, ৫৩৫ যা তাদেরকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করেছে। জিডিপি গ্রোথ বেশ ভালো প্রায় ৮.৮%। ট্যুরিজম জিডিপির ২৮% এর মত তবে তাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রায় ৬০% আসে এ খাত থেকে। মূল আয়ের উৎস ট্যুরিজম, ফিসিং এবং শিপিং ইত্যাদি। ক্লাইমেট চেঞ্জের প্রভাবে অনেক বিশেষজ্ঞরা বলেন এ দেশ একদিন পানির নিচে তলিয়ে যাবে, মনে পড়ে বেশ কষ্ট বোধ হচ্ছিলো। এত সুন্দর দেশটির এ অবস্থা হবে! নিশ্চয়ই সরকার একে রক্ষার জন্য ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
মজার ব্যপার হলো এ দ্বীপের আইল্যান্ডগুলো স্থাপন করেছিল বুদ্ধিস্টরা, তারা সাউদারন এশিয়া থেকে এসেছিল ৩০০ বিসিতে এবং এখানে ইসলাম ধর্ম প্রবর্তিত হয়েছিলো ১২তম সেঞ্চুরিতে। কোন কোন জায়গায় বলা হয়েছে ১১৫৩ সালে মালদ্বীপ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয় এবং তারা মুসলিম কেলেÐার ব্যবহার করে, মহিলারা হিজাব ব্যবহার করে। ধর্ম তাদের শিক্ষার একটি অংশ।
পর্তুগীজরা এদিকে বাণিজ্য করতে এসেছিলো ১৫তম সেঞ্চুরির মাঝামাঝি সময়ে। যদিও একজন স্থানীয় সুলতান দ্বারা এ দেশ শাসিত হচ্ছিল কিন্তু এখানে ইউরোপিয়ানদের প্রভাব ছিল। ১৮৮৭ সাল থেকে মালদিপস আইল্যান্ড ফরমালি ব্রিটিশ প্রটেক্টরেট হিসেবে অর্থাৎ একটি ট্রিটিএর মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসনের দ্বারা শাসিত হতে থাকে। এবং সালতানাত হিসাবে স্বাধীনতা পায় ১৯৬৫ সালে তার তিন বৎসর পর জনগণ ভোট দিয়ে রিপাবিøক স্থাপন করে। এবং ১০০ বৎসর পর দেশটি একটি কনস্টিটিউসন পায়।
মালদ্বীপ টুরিস্ট আমন্ত্রণে সদা প্রস্তুত, মালদিপস এয়ারলাইন্স এর সরাসরি ফ্লাইট রয়েছে চেন্নাইতে এক ঘন্টার বিরতিসহ প্রায় চার থেকে সাড়ে চার ঘন্টার জার্নি। হুলহুমালের সিজন্স হলিডেতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল একেবারে বিচের পাড়ের হোটেলটিতে। খুবি ছোট্ট জায়গায় এটি। সময়টি অক্টোবর মাসের এগার তারিখ, ২০১৭। আমাদের টিমে দশজন ছিলাম। একেক জনের একেক রকম দায়িত্ত ছিলো পদবিও ছিল। কেউ ক্যামেরাম্যান কেঊ টিম লিডার, কো-টিম লিডার, হিসাব রক্ষক, সদস্য, মহিলা সদস্য। যার যার দায়িত্তে সকলে সঠিক ভাবে নিয়োজিত, বিন্দুমাত্র ভুল হবার জো নেই, হলে সাথে সাথেই সমালোচনা তাই সকলে বেশ সজাগ।
ওরা সরকার থেকে জমি কেনে এবং বিচের পারের জমি বেশ দামি, হোটেল মালিক জানালো প্রায় ৩.৭ মিলিয়ন রূপিয়া দিয়ে কিনেছে তার পর ব্যঙ্ক থেকে লোন নিয়ে হোটেল তৈরি করেছে। বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১৫-১৬ কোটি টাকা খরচ পড়েছে। তাই সেবার দামও বেশি। মাত্র দশ বাই দশ একটি রুমের ভাড়া প্রায় বাংলাদেশের সোনারগাও হোটেলের সমান। অন্যন্য সুযোগ সুবিধাও সীমিত অর্থাৎ একটি থ্রি-স্টার হোটেলের মতো।
হুলহুমাল থেকে রাজধানি মালে বেশ কাছে। আমরা মালের বিভিন্ন জায়গা দেখতে যাব কাল ঠিক হলো। মালের পার্লামেন্ট হাউস, প্রেসিডেন্ট হাউস, এন্টি-করাপ্সন কমিশন, শতাব্দী পুরান স্কুল, পার্ক দেখা হল। মালের বিখ্যাত মসজিদও দেখা হলো। ছোট জায়গা বলে হেটেই দেখা গেল সবকিছু। অনেকটা হেটে সবাই বেশ ক্লান্ত, কিছু হস্তশিল্পের দোকান ঘুরে মাছের বাজার দেখে তার উপরের একটি রেস্তরায় বসে সবাই আড্ডা দিচ্ছি। শেলের তৈরি ক্রোকারিজ অনেকে পছন্দ করলেন, প্রচুর দাম, তিন সেট বাটি তেরশত ডলার দাম হেকে বসেছে, শেষে সাতশত ডলারে রফা হলো। গাইড আগেই বলেছিল দরদাম করতে হবে। একেবারে বাংলাদেশের হকারস মারকেটের কথা মনে করিয়ে দেয়। কোন জিনিষের দাম অর্ধেক বলে শুরু করতে হয়।
পছন্দ মত জুস এবং ড্রিঙ্কস পাওয়া গেলো। হোটেল থেকে দেখা যাচ্ছিলো সব্জী এবং মাছের নৌকা বিভিন্ন জায়গা থেকে আসছে তাদের মালামাল তুলে দিয়ে আবার যার যার গন্তব্যে চলে যাচ্ছে। অনেকটা চট্টগ্রামের রিয়াজুদ্দিন বাজারের মত। ফিশ মার্কেটে সব চাইতে বেশি দেখা গেলো টুনা, এত বড় টুনা ফিশ আমি আর দেখিনি। মাছ গুলোর পরিস্কার এবং কাটা কূটির দৃশ্য কেউ বা ভিডিও করল তবে আমাদের দেশের মাছের বাজারের থেকে পরিস্কার মনে হলো তবে মাছের প্রকট গন্ধ। প্রত্যেকের জন্য একটা করে টাইলস দেয়া কিউব বররাদ্দ আছে, তার প্রাপ্য জায়গায় তার মাছগুলো সে রাখবে। মালের কমার্শিয়াল অংশটি খানিক বোঝা গেলো। মাছ এবং টুরিস্ট এদের প্রধান আয়করী খাত।
কিন্তু বিপদ হলো ফেরার পথে। একটা মাত্র গাড়ি পাওয়া গেছে। একবারে চারজন যেতে পারে। চারজন গাড়িতে উঠার জন্য রওনা হয়ে গেল গাইডের সাথে, কিন্তু প্রায় এক ঘন্টা পর আবার তারা ফিরে এসেছে কারণ কি? এখানে কোন এক মিনিস্টার এসেছে যে কারণে রাস্তা বন্ধ, কোন ভাবেই গাড়ি ঢুকতে পারছেনা হোটেলের কাছে। যে চারজন ফিরে এসেছে তারা গাইডের উপর ভিষণ রাগান্বিত, সে কেন এতক্ষণ দাড় করিয়ে রেখেছে তাও বৃষ্টির মধ্য। বেশ খানিকক্ষণ পর গাইড এসে হাজির, তার চোখে মুখেও ভয়ের ছাপ, সে মনে করেছে টুরিস্টদের হারিয়ে ফেলেছে। আমার বেশ মায়া হলো তার চেহারা দেখে। এর পর বেশ খানিকক্ষণ ফোন, তর্ক বিতর্ক চলতে থাকল, কেন গাইড গাড়ি ঠিক না করে অচেনা এ টুরিস্ট দের দাড় করিয়ে রেখেছে। মিনিস্টারকে সম্বর্ধনা দিতে বিপুল লোকের আগমন হয়েছে, একেই রাস্তা ঘাট কম তার উপর সমাবেশ আর বৃষ্টি সব মিলে আমাদের সন্ধ্যেটা প্রায় মাটি হতে বসেছিল। গাইড বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে ব্যপারটি বোঝানোর চেষ্টা করছিলো। আমার কাছে হোটেলের কার্ড ছিল সেখান থেকে ফোন করা হল। হোটেল থেকে জনাব শিবাজি হোসেন একটা গাড়ি নিয়ে অল্প সময়েই চলে আসলো, আর একটি গাড়ি আগেই মোটামোটা তৈরি ছিল। ছাতা মাথায় সকলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। রাস্তায় পানি জমে গেছে মুহূর্তে, নোংরা পানি, মাছের গন্ধ। তবে একটু ঠাÐা বাতাস পাওয়াতে সকলের মেজাজ কিছুটা শান্ত হল। প্রচুর বৃষ্টির মধ্য আমরা কোন মতে গাড়িতে উঠলাম এবং সিজন্স হলিডেতে এসে পৌঁছলাম। মনে মনে ভাবলাম মালদ্বীপের সাথে আমাদের এদিকটায় মিল রয়েছে, কোন রাজনৈতিক নেতা কোথাও আসলে তাকে নিয়ে যে হই চই তাতে সাধারণের সমস্যার ব্যপারে সরকার একেবারেই একনিষ্ঠ নয় তাতে টুরিস্ট হোক বা অন্য যেকেউই হোক। দু তিন ঘন্টা ধরে সাধারণ মানুষ আটকে রইলো কেবল মিনিস্টারের সম্বর্ধনার জন্য।
রাতে হোটেলেই খাওয়ার আয়োজন। মালদ্বীপে এসে সি-ফুড খাওয়া হবেনা তা কি হয়। বেশ বড় সড় মাছ সেদ্ধ করে সাজিয়ে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। সকলেই মনের আনন্দে মাছ সাবাড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমার সামুদ্রিক মাছে একটু এলারজি রয়েছে তার ওপর পাউরুটি দিয়ে এ মাছ। খাবার টেবিলে অনেক মজার গল্প হল, দেশে এরা সব এক একজন কত বড় দায়িত্বে রয়েছে দেখলে বুঝার উপায় নেই। মনে হলো অনেকগুলো শিশু অপার আনন্দে নিজেদেরকে মালদ্বীপের এ আবহাওয়ায় সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষে পরিণত হয়েছে, যা বলার নয়, তাই বলছে যা করার নয় তাই করছে। মনে হবে সত্যিই আনন্দ ভ্রমণে এসেছেন।
মালদ্বীপে বেড়াতে এসে সবচাইতে যেটা দেখলাম তা হল, প্রচুর বাংলাদেশী এখানে কাজ করে, হোটেলে, রিসোর্টে, ফিশিং, আইল্যন্ডগুলোতে, শিপে, মুদি দোকানে, মাটি কাটার কাজে, কিচেনে, শেফ হিসেবে অসংখ্য বাংলাদেশী, আমাদের জন্য রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে। প্লেনেই কথা হচ্ছিলো জনাব আব্দুর রহমানের সাথে, তিনি ১৪ বৎসর থেকে এ দেশের টুরিস্ট জাহাজে কাজ করছেন। সেখানে তিনি শেফের কাজ করেন, জিজ্ঞাসা করলাম, কাজ কীভাবে শিখেছেন, তিনি জানালেন দেখতে দেখতে শিখেছেন, তিন চারটা সার্টিফিকেটও আছে। তিনি পাঁচশত ডলার বেতন পান, তবে টিপস এর ক্ষেত্রে বেশ ভালো নিয়ম, এগুলো এক জায়গায় জমা হয়, সকলে পজিশন অনুযায়ী এর ভাগ পায় তাতে তার আরো তিনশত ডলার আসে। সব মিলিয়ে তিনি ভালোই আছেন। আব্দুর রহমান বেশ খুশী তিনি বাড়িতে নিয়মিত টাকা পাঠাতে পারছেন। সেখানে তার পরিবার ভালই আছে, আট্ মাস কাজ করে বাড়িতে গিয়েছিলেন আব্দুর রহমান, যথেষ্ট হাসি খুশী জনাব রহমান আমাকে তার শিপে বেড়ানোর আমন্ত্রণও জানালেন।
আরও কথা হলো জনাব শহিদের সাথে তিনি মুদি দোকানে কাজ করেন, বেতন পান তিনশত ডলার। মাত্র আঠার বৎসর বয়সে বিদেশে এসেছেন, মালদ্বীপের লোকজনের সম্পর্কে ভালো মন্তব্য করলেন। তবে সেখানে কয়েক ধরনের কন্টারক্টর আছে, কেউ সিঙ্গাপুর থেকে এসেছে, কেঊবা মালদ্বীপের। বিদেশি কনট্রাক্টর ভালো বেতন দেয়। তাদের বক্তব্য বাংলাদেশীরাই তাদের জন্য সমস্যা, এজেন্ট এর মাধ্যমেই এদেশে আসতে হয় কারণ সরকারের সাথে কোন জিটুজী কট্রাক্ট নেই। এজেন্ট তাদের কাছ থেকে দশ লাখ থেকে পনের লাখ টাকা নিয়ে নেয়, যা তুলে আনতে তাদের অনেক সময় লাগে। প্রায় এক কোটি বাইশ লক্ষ অভিবাসী বিদেশে আছেন। তার মধ্য মালদ্বীপে ঠিক কতজন রয়েছে তা সরকারি হিসাব থেকে সঠিক জানার উপায় নেই। তবে সুযোগ রয়েছে অনেক কর্মসংস্থান এর, এ বিষয়গুলো সরকারের নজরে থাকলে আরও অনেকে এখানে চাকরি নিয়ে আসতে পারতো।
বাংলাদেশী কাউকে পেলেই কথা বলি, মনে হয় এরা এ দেশে পড়ে আছে পরিবার পরিজন ছেড়ে শুধু কিছু অর্থ রোজগারের তাগিদে। কেউ তাদের তেমন সন্মানের চোখে দেখেনা কারণ তারা খুব ছোট চাকরি করে। তারা ফরেইন এক্সচেঞ্জ দেশে পাঠায় তবে তা সরকারি চ্যনেলে নয়। তাই স¤প্রতি ঘোষিত ২% ক্যাশ ইনসেন্টিভ কেউ ভোগ করতে পারেনা। কথা হলো জনাব দেলোয়ার হসেনের সাথে তিনি ছয় বৎসর যাবত এ দেশে আছে। তিনি মাসে ৯৭৫ রুপিয়া দেশে ‘বিকাশে’ পাঠান তার পরিবর্তে দেশে ৫০০০ টাকা তার পরিবার পেয়ে যায়, খুব সুবিধা সাথে সাথে টাকা ট্রান্সফার হয়ে যায়। এতে সে প্রতি মালদিভিয়ান রুপিতে তিনি পাচ্ছেন ৫.১২ টাকা কিন্তু দেশে কিনতে লাগে প্রায় ৫.৬০ টাকা। অর্থাৎ দেশের কার্ভ মারকেটে বিক্রি করলে প্রতি রুপিয়ায় প্রায় পঞ্চাশ পয়সা লাভ হতো। যাই হোক তার পরিবার সাথে সাথে টাকা পেয়ে যাচ্ছে এটাই তার জন্য অনেক সুবিধা। অন্যন্যদের মতো জনাব দেলোয়ারও এ দেশের লোকের প্রশংসা করলেন। জানালেন বেতন দিতে এরা বেশ নিয়মিত, পুলিশ ভাইরাও তাদের কখনো কিছু বলেনা বোঝা গেলো এদেশ বিদেশী কর্মীদের উপর ব্যপক ভাবে নির্ভরশীল, এবং এটা আরো দীর্ঘদিন অব্যাহত থাকবে।
হোটেলে থাকাকালীন আরও একজনের সাথে দেখা হলো তার পদবী জানালেন ফ্রন্ট অফিসার, তবে মালদ্বীপে সকলে সব ধরনের কাজ করে, সিবাজি হোসেনের কথা আগেই বলেছি তিনি মালিক আবার হোটেলের গাড়ীটিও তিনিই ড্রাইভ করেন, আমাদের রিসিভ করা এবং পৌঁছে দেয়া তিনিই করলেন। বেশ বুদ্ধিমান এ মালদিভিয়ান তিনি তার ব্যবসা আরো বড় করতে চান, বাংলাদেশ সম্পর্কে তেমন জানেননা তবে সুযোগ পেলে বেড়াতে আসবেন।
বিচে কথা হচ্ছিলো গুলে শাহ এর সাথে, বেশ ভালো ইংরেজি জানে, তিনি ড্রাইভারের স্ত্রী, বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে বিচে এসে আপেক্ষা করছে স্কুল শেষ হলে তাদের নিয়ে বাসায় যাবে। ছেলেদের বয়স তের এবং চৌদ্দ, জিজ্ঞাসা করলাম হুলহুমালেতে তেমন ট্রাফিক নেই ওরা নিজেইতো ফিরতে পারে, তিনি জানালেন অনেক ড্রাগ এডিক্ট রয়েছে আশে পাশে, তাই ছেলেদের তিনি ছাড়েন না। তার স্বামী বেশ ভালো রোজগার করেন প্রাইভেট গাড়ি চালান। মালের মেয়েরা বেশ মোটা তবে স্বাস্থ্য সচেতন। দৈনিক একজন কোচের অধীনে সমুদ্রের পানিতে ব্যয়াম করে, দেখা হল, হাফসা, হাফিজার সাথে, একটা ছবিও তুললাম, ভিজে কাপড়ে ছবি তুলতে কোন আপত্তি করলনা। বেশ স্মার্ট ভাল ইংরেজিও বলতে পারে, দেখতে খুবই সাধারণ ।
আমাদের দ্বিতীয় দর্শনীয় স্থান ছিল পারাডাইস আইলেন্ড। মালে এয়ারপোর্ট এ এসে সিবোট এ করে সমুদ্রের মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হবে। আধাঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম, টুরিস্টদের জন্য বেশ প্রি-কসন নেতে হয়, লাইফ জ্যাকেটও পড়তে হলো। ঢুকেই বেশ ভালো রিসিপসন। সমুদ্রকে এমব্যাকমেন্ট দিয়ে শান্ত জলের উপর কাঠের রাস্তা অনেকটা ছোট বাধের উপর কাঠের তক্তার উপর দিয়ে হাটা, এর সাথে ঝির ঝিরে বাতাস, দু পাশে দুধ সাদা বালির ওপর স্বচ্ছ ফটিকের মত পানি। অসম্ভব সুন্দর একটি অনুভূতি, সকলেই ভীষণ ভাবে আপ্লুত। বেশ বড় রিসিপ্সন রুম, বিশেষ ভাবে তৈরি জুস দিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করা হলো, তার আগে ঠাÐা তোয়ালে দিয়ে হাত মুখ মুছে নিয়েছি। এবার ফর্ম পুরণ করতে হবে। আমাদেরকে ১৭০-১৭৪ নং ভিলা দেয়া হল। বাগীতে চড়ে আমরা রুমে পৌঁছলাম। ভিলাগুলো বেশ বড় সড়, শোবার ঘর, আলোঝলমল, সামনেই ছোট লেকের মত তার পরে রিফের দেয়াল তার ওপারে আসল সমুদ্র, শুধু গর্জন শোনা যায়, সামান্য দেখাও যায়। এখান থেকে মালে দেখা যায়, নুতন নুতন স্থাপনা। মালেতে ৬০% জমি অরিজিনাল, বাকিটা রি-ক্লেইম করা, প্রতিদিনই তারা রি-ক্লেইম করে জমি বাড়াচ্ছে, আর সমুদ্রকে কত কাজে লাগানো যায়। পানিই এদের সম্পদ, আর আছে মাছ। বেশ কিছু ফলও হয় এখানে।
প্যারাডাইস আইল্যান্ড, লাঙ্কানফিনলহু, মালদিভস মাত্র ০.৯৯৯ বা ১ কিলমেটার জুরে। খাবার জায়গাটা বিশাল, এখন অক্টোবর-নভেম্বের পর্যটন সময় তাই প্রায় পুরো জায়গাটাই ভর্তি, একসাথে প্রায় ৩০০ লোক খেতে পারে। প্রায় ৯০০ লোক কাজ করে এখানে তার মধ্যে প্রায় ২০% বাংলাদেশী।
একটু দূরে ফারুমাথি রেস্তরা যেখানে সবচাইতে মজার বিষয় হলো সার্ক ফিডিং এবং পূর্ণ চাঁদ দেখা। ১৪ই অক্টোবর ছিল ফুল মুন, সে উপলক্ষে পার্টিও ছিল। কাঠের পাটাতন এর উপর সুন্দর করে সাজানো রেস্তরা, সামনের দিকে বেশ কিছুটা খালি জায়গায় চেয়ার পাতা রয়েছে, ছাতাও রয়েছে, এখান দূরের আকাশ, সমুদ্রের বাতাস, গন্ধ এবং দূরে মালে শহর ও সর্বোপরি কিছুটা দূরে সমুদ্রের প্রান্ত দেখা যায়। কাঠের পাটাতনের নিচে অসংখ্য মাছ এবং সার্কের আনাগোনা। ঠিক সন্ধ্যে সাতটার সময় এদের খাবার দেয়া হবে তাই দলে দলে সার্ক আসতে শুরু করেছে। মাছ কিছুটা পচিয়ে এদের দেয়া হয়।
খাবার পেয়ে কী অসম্ভব ঝাপ্টা ঝাপ্টি এদের দেখার মতই। এতক্ষণ শান্তভাবে ঘোরা ফেরা করছিলো এখন আর তা নয়, একেবারে মানুষের মত হল্লা করছে। সার্ক বিভিন্ন সাইজের, কোনটা বেশ বড়, দাঁতো কিছুটা দেখা যাচ্ছে, কোনটা ছোট। অন্ন্যন্য মাছও আছে কিন্তু এরে সেগুলোকে বিরক্ত করেনা। ওদের সময় জ্ঞান দেখে অবাক লাগলো। আরো এক ধরনের মাছ আমরা যাদেরকে শাপলা মাছ বলি। ওদের খাবার দেয়ার সময় আরো পরে। যিনি এদের সেবা যতœ করেন তাদের জিজ্ঞাসা করলাম এ রকম কতগুলো মাছ রয়েছে, জানালো ৯টি মাছ, সকলে এদের খাবার খায়ানো এঞ্জয় করলো, আমিও যোগ দিলাম।
এখানে রয়েছে অসংখ্য বার, এমন একটি হুলহাঙ্গু বার। আমরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য বসে রইলাম অনেক সময় ধরে আর ভাবলাম প্রকৃতি কত সুন্দর কত পরিচ্ছন্ন। আমাদের সমুদ্র সৈকতকেও আমরা পারি সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতে কিন্তু কবে সে দিন আসবে, আমরা হয়ত দেখে যেতে পারবনা। মালদ্বীপ শুধুমাত্র পর্যটনের ওপর নির্ভর করে বেচে আছে, আর আমরা এখনও বিচটাকে পরিস্কার রাখবো তাই পারিনা।
খাবার ব্যপারে বলতে গেলে বাঙালিদের পছন্দনীয় তেমন নয় ইউরপিয়ানদের চাহিদা এবং টেস্টের দিকে নজর রেখে খাবার মেনু তৈরি হয়েছে। এটা অবশ্য সত্যি টুরিস্টদের মধ্য ইউরোপিয়ানরাই বেশি, তবে এশিয়ান বিশেষ করে ভারত, বাংলঅদেশ, কোরিয়া, নেপাল থেকেও টুরিস্ট আসছে। গারুদিয়া মালদ্বীপের জাতীয় খাবার এটা স্টিমড রাইস বা চাপাতি দিয়ে খাওয়া যায়। মালদ্বীপের চার ভাগের তিন ভাগ পানি তাই মাছ বিশেষ করে টুনা মাছ এদের প্রধান খাবার। নারকেল আর একটি প্রধান খাবার। এছাড়া থেলুই, গুলহা, ম্যস রশি, কেইমিয়া, বাজিয়া, ম্যাস হুনি মালদিভিয়ান কালচারের সাথে মিশে আছে। স্থানীয় ড্রিঙ্কস এর মধ্য রায়া, নারকেলের মিশ্রণের ড্রিঙ্কস অন্যতম।
এ সব কিছুর টুরিস্টদের মনোরঞ্জনে এখানে আছে বিলাসবহুল স্পা, যেখানে মূলত ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিনের শিক্ষিত মেয়েরা কাজ করে। প্রবালঘেরা সচ্ছ পানিতে সাতার কাটা, স্কুবা, অন্যন্য যে কোন আনন্দের জন্য আলাদা আলাদা চার্জ করে উপভোগ করা যায়। ছোট ছোট দ্বীপে জেলেরা থাকে তাদের সাথেও কিছু সময় কাটিয়ে আলাদা আনন্দ পেতে পারে ভ্রমণকারিরা।
আমাদের সময় কেটেছে বেশির ভাগ মজার মজার গল্পে। এ এক অন্য পৃথিবী যেখানে সময় কাটানো শুধু আনন্দে আর ফুর্তিতে। আমাদের দলের সকলেই প্রায় সমবয়সী তাই মনের মিল রয়েছে। কেউ একটু বেশি ছবি তোলার দিকে কেউ বা গান শুনে বা প্রকৃতি দেখেই সন্তুষ্ট। তবে এটা অবশ্যই সত্যি একটু সেবার জন্যই দরকার, মালদ্বীপ ভ্রমণ একঘেয়েমি জীবনের মধ্য একটু ছন্দপতন, একটু মনে রাখা, ফেস বুকে ছবি পোস্ট, কিছু কমেন্টস, সব মিলে ভালই।
বাংলাদেশের জন্য ছোট মালদ্বীপ থেকে শেখারও আছে অনেক। একেবারেই ঝকঝকে সমুদ্র তীর, সাদা বালি যেখানে কোন ময়লা নেই, সবাই নিয়ম মেনে চলছে, সমুদ্রের পারে হরেক রকমের পসরা সাজিয়ে বসে পড়েনি দোকানী, পর্যাপ্ত সিকুরিটি। মালদ্বীপ মুসলিম দেশ হলেও অন্য জাতের টুরিস্টদের মন রক্ষার্থে ঠিকই সব ব্যবস্থা করেছে। পর্যটনকে প্রকৃত অর্থেই শিল্প হিসাবে নিয়েছে।
ফিরে যাওয়ার দিন চলে এসেছে, সকলে খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেছি, সকাল সারে আটটায় ফ্লাইট। আবার হেটে পাড় হচ্ছি সেই কাঠের সিড়ি, নিচে আছড়ে পড়ছে স্বচ্ছ পানি, ভেসে যাচ্ছে অসংখ্য মাছ আর অনেক কিছু। সামনেই একটা বড় বøকের ওপর লেখা আই লাভ প্যরাডাইস, দৌরে গেলাম এক বন্ধুকে বললাম একটা ছবি তুলতে। সি-বোটে উঠলাম আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে আসলো পারাডাইস আইল্যান্ড। স্মৃতিটুকু ধরে রাখতে চাইলে বন্ধুর তোলা ছবি জীবনের জন্য বাধাই কওে রাখতে পারেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *