মাওলানা সাইয়্যিদ শাহবাজ মুহাম্মদ ভাগলপুরী (রহঃ)-

Spread the love

পর্ব-২

মক্কা শরীফ থেকে প্রত্যাবর্তন- দীর্ঘ ৩ বছর ইলমে হাদীস হাসিল করার পর তিনি মক্কা মুয়াযযামায় হজ্জ পালন করেন এবং সেখান থেকে ৯৭৫ হিজরীতে রওযায়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম এর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে পবিত্র মদিনায়ে মুনাউয়ারায় হাজির হন। অতঃপর সেখানে দয়াল নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম এর রওযায়ে আতহারে সালাতো সালাম পেশ করেন। সেখান থেকে বিদায় নেয়ার পর হুযুর সুলতানুল আরিফিন এর অন্তরে মাওলায়ে কায়েনাত হযরত আলিয়্যুল মুরতাযা ও সায়্যিদুশ শুহাদা ইমা্ম এ আলী মাকাম ইমাম হুসাইন আলাইহিমাস সালাম এর মাযারে পাক যিয়ারাত করার গভীর আকাঙ্ক্ষার উদ্রেক হয়, সুতরাং, তিনি নাজাফে আশরাফ এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন এবং সেখান থেকে কারবালায়ে মুয়াল্লা, কাযিমাইন (ইমাম মুসা কাযিম আলাইহিস সালাম ও ইমাম মুহাম্মাদ জাউয়াদ আল তাকী আলাইহিস সালাম এর মাযার শরীফ) হয়ে হিন্দুস্তানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে এক অলৌকিক ঘটনা প্রকাশ পায়, হুযুর সুলতানুল আরিফিন বর্ণনা করেন, “যখন আমি আফগানিস্তানের হেরাত নামক স্থান এর গভীর জঙ্গল এর মাঝ দিয়ে অতিক্রম করছিলাম, তখন ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় কাবু হয়ে পড়েছিলাম, এবং আশেপাশে কোন জনবসতিও দেখতে পাচ্ছিলাম না। এমন সময় দেখতে পেলাম রাস্তার শেষপ্রান্তে একজন ব্যক্তি দাঁড়িয়ে রয়েছেন যার চেহারা কাপড় দ্বারা আবৃত ছিল, ক্রমেই তিনি আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন এবং একটি খুরমা আমার হাতে দিয়ে বললেন, “এটা খাও” আমি খেয়ে নিলাম, তিনি আবার খুরমা দিলেন, আমি আবার খেয়ে নিলাম তিনি তৃতীয় বারের ন্যায় খুরমা দিয়ে চলে গেলেন এবং আমি তা খেয়ে চিন্তা করতে লাগলাম কে এই পরিচয় গোপনকারী ব্যক্তি ? এবং এই খুরমাগুলো কেমন ? এ কথাগুলো চিন্তাই করছিলাম এমন সময় আমি হঠাৎ দেখতে পাই, তিনি পূনরায় আমার দিকে ফিরে আসছেন এবং এসে চেহারা অনাবৃত করে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,“فرزندم٬غممخور٬منجدشماعليام”অর্থাৎ, আমার প্রিয় সন্তান, তুমি ভয় করোনা, আমি তোমার দাদা (পূর্বপুরুষ) আলী, প্রথম খুরমাটি শরীয়ত, দ্বিতীয় খুরমাটি মা’রিফাত এবং তৃতীয় খুরমাটি হাকিকাত।ভাগলপুরে আগমন ও মাদরাসা নির্মাণ- হুযুর সুলতানুল আরিফিন মুঘল সম্রাট জালালুদ্দিন মুহাম্মাদ আকবর এর শাষনামলে ৯৮৫ হিজরীতে ভাগলপুরে আগমন করেন, তৎকালীন সময়ে ভাগলপুর ছিল একটি ছোট ও অপিরিচিত গ্রাম ।তিনি সেখানে একটি মাদরাসাকায়েম করেন, নাতিদীর্ঘ সময়ে যাএকটি আজিমুশশান বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ ধারন করে এবং যার ইতিহাস মুসলিম ও অমুসলিম ইতিহাসবিদগণ স্ব স্ব ইতিহাসগ্রন্থে অকপটে বর্ণনা করেন এবং এর খ্যাতি উপমহাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে যায়। অল্প সময়েই তালিবে ইলমদের পদাচরণে মুখরিত হয়ে উঠে ভাগলপুরের যমীন। জ্ঞান বিতরণেরকেন্দ্র হিসেবে ভাগলপুর নিজ পরিচয় পরিবহণ করতে আরম্ভ করে, সুলতানুল আরিফিন এর একেকটি দারসে পাঁচ শতাধিক ছাত্র অংশগ্রহণ করতেন ফলে, প্রায় সময়ই ছাত্রদের আধিক্যের কারণেমাদরাসায় ছাত্রদের থাকার ব্যবস্থা করা দূষ্কর হয়ে পড়তো ।ছাত্রদের মাঝে অধিকাংশই মুলতান, লাহোর, দিল্লী, পাঞ্জাব, সেরহিন্দ, বিহার, বাঙ্গাল, উড়িষ্যা, জৌনপুর, কান্নৌজ, গাজীপুর ইত্যাদি স্থান থেকে আগমন করে ইলমে শরীয়ত ও মা’রিফাত হাসিল করে আত্মশুদ্ধি করতেন । সুলতানুল আরিফিন তাঁর মাদরাসায় হিফযুল কুরআন, ইলমে তাজভীদ, ইলমে কিরাআত, উলুমুল কুরআন, ইলমে তাফসীর, উসুলে তাফসীর, ইলমে হাদিস, উসুলে হাদিস, ইসনাদে হাদিস, আসমাউর রিজাল, জারহ ও তা’দিল, তাখরিজে হাদিস, লুগাতে হাদিস, ফিকহ, উসুলে ফিকহ, রাসমুল মুফতী, ইলমুল আকাঈদ, ইলমুল মুনাযারাহ, ইলমুল ফারায়েয, সিয়ার, ইলমুল কালাম, ইলমুল মাআনী, ইলমুল বাদী’, ইলমুল বায়ান, ইলমুল মানতিক, ফালসাফাহ, ইলমুল হিকমাত, ইলমুল হাইআত, ইলমুল আখলাক, তারীখ, ইলমুল আনসাব, লুগাত, সাহিত্য, হিসাববিজ্ঞান, জ্যোতিরবিদ্যা, তাওরকাবিদ্যা, ইলমে তা’বীর, ইলমে বালাগাত, ইলমে সারফ, ইলমে নাহভ, প্রকৌশলবিদ্যা, সুলুক ও তাসাউফ ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা দিতেন ।কথিত রয়েছে, প্রাথমিক দিকে হুযুর সুলতানুল আরিফিন নিজেই, সমস্ত বিষয় এর পাঠদান করতেন, তবে পরবর্তী সময়ে অধিকহারে ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় তিনি ক্লাসগুলো নেয়ার দায়িত্য তাঁর শাগিরদ, খাদিম, খলীফা ও সন্তানগণের মাঝে বন্টন করে দেন ।হুযুর সুলতানুল আরিফিনের এক অনন্য বৈশিষ্ট ছিল এই যে, তিনি তাঁর শিষ্যদের পাঠদান করে শুধু কর্মযোগ্যই বানাতেন না বরং তাদেরকে বিভিন্ন জায়গায় দ্বীনের খিদমতের কাজেনিয়োজিতও করে দিতেন, যেমনটা আমরা দেখতে পাই ভাগলপুর শহর ও এর আশপাশের এলাকা সমূহের অধিকাংশ মসজিদ, মাদরাসা ও খানকাহসমূহ হুযুর সুলতানুল আরিফিনের আউলাদগণ, শিষ্যগণ ও খলিফাগণের নামে নামকরণকৃত।ইলমুল হাদিসের চর্চা- হুযুর সুলতানুল আরিফিন এর সহিত ইলমুল হাদিসের এত নিবিড় সম্পর্ক ছিল যা কল্পনাতীত। তিনি ইলমুল হাদিসের চর্চায় দিনরাত মগ্ন থাকতেন। হাদিসে পাকের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা তাঁর নিত্যদিনের কাজ ছিল, কিন্তু আফসোস এর বিষয় হল অধিকাংশ পান্ডুলিপিই হাড়িয়ে গিয়েছে তবে সুলতানুল আরিফিন এর সহস্তে লিখিত একটি কিতাব “সিত্তিন শরীফ” নামে প্রকাশিত হয়েছে । যে কিতাবে তিনি ৬০টি হাদিসে পাক সরাসরি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম হতে মুরাকাবার মাধ্যমে শ্রবণ করে লিপিবদ্ধ করেছেন ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *